কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. আবু নাঈম। প্যাথলজি বিভাগের শিক্ষক তিনি। বর্তমানে কাজ করছেন করোনা পরীক্ষার আরটি-পিসিআর ল্যাবে। কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার গুণানন্দীতে তার বাড়ি। এ দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসক মেডিকেল কলেজে চাকরির পাশাপাশি ফাঁকা সময়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। কিন্তু ডা.নঈম ব্যতিক্রম। তিনি মজে থাকেন বৃক্ষ নিয়ে।
তার বাড়ির নাম আরণ্যক। বাড়িটির দুতলা ভবন এবং চারপাশের প্রায় সবটাই সবুজে আচ্ছাদিত। সামনের বাগানে সারিসারি ছায়া বৃক্ষরাজি। ডা. নাঈমের বাগান রয়েছে কয়েক হাজার প্রজাতির লক্ষাধিক বৃক্ষ। এ বৃক্ষগুলোর বীজ, ডাল থেকে তিনি চারা করেন। কুমিল্লা গার্ডেনাস সোসাইটি নামে ফেসবুক পেজের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এই পেজের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি চারা বিন্যা মূলে বিতরণ করেছেন তিনি।
তার বাড়িতে আছে এগ্লোনিমা, ফার্ন, বেগুনিয়া, ক্যালাথিয়া, ডাইফেনবাকিয়া, স্নেক প্ল্যান্ট, রিও, কাস্ট আয়রন প্ল্যান্ট, হরেক রকম পেপারোমিয়া এনথুরিয়াম ইত্যাদি। এনথুরিয়ামসহ ছায়া বৃক্ষরাজির কুমিল্লার সবচেয়ে বৃহৎ ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা এটি।
পুরনো আম গাছজুড়ে পরম যত্নে লালিত হচ্ছে আমাদের দেশজ নানাবিধ প্রজাতির অর্কিড, হয়া ও এপিফাইটিক গাছ। তার মধ্যে রিংকোস্টাইলিস, ভ্যান্ডা এচাম্পি, বালবোফাইলাম, ডেন পারিশি, এরিইডিস, ডেন ফরমোসাম, ব্লু ভ্যান্ডা, পিয়ারাড্ডি, সিম্বিডিয়াম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ভিনদেশি অর্কিডরাজিও কয়েক প্রজাতির ভ্যান্ডা, মোকারা, ডেনড্রবিয়াম, ফ্যালনপসিস। হরেক রকম হয়া, এন্ট প্ল্যান্ট অর্কিড সংগ্রহ আরো সমৃদ্ধ করেছে। একটি ছাদজুড়ে রয়েছে চল্লিশটি গোলাপ গাছ, অলকানন্দা, দেশি জুঁই, হানিস্যাকল, অলকানন্দার পাঁচটা প্রজাতি, চীনের সিয়াম টিউলিপ ইত্যাদি।
বাতাসেও যে গাছ মাটি ছাড়া বেঁচে থাকে সে গাছের সমাহার রয়েছে ডা. নাঈমের বাড়িতে। প্রায় ১২ প্রজাতির এয়ার প্ল্যাান্টস রয়েছে এই সংগ্রহশালায়।
অপর ছাদে উঠে দেখা গেলো সারি সারি টব। সংখ্যায় হাজারের বেশি বড়-ছোট টব রয়েছে সেখানে।
ফলজ গাছের মধ্যে আছে মাল্টা, বেরি, মিশরীয় ডুমুর। মসলা গাছ একাংগী, কারিপাতা গাছ ইন্ডিয়ান জিঞ্জার রয়েছে। একই পাতায় সাতটা গরম মসলার ঘ্রাণ যুক্ত অল স্পাইস মশলার চা দারুণ স্বাদের হয়। এ দেশে এই গাছের বাণিজ্যিক চাষাবাদের সুযোগ রয়েছে।
চাঁপাফুল গাছের জন্য আলাদা একটা স্থান আছে ছাদে। আরো আছে দেশি-বিদেশি চার রকম দোলন চাঁপা, হিম চাঁপা, স্বর্ণ চাঁপা, ভুঁই চাঁপা, স্বরস্বতী চাঁপা, ম্যাগনোলিয়া, বৃন্দাবন চাঁপা, গুঁলাচ চাঁপা, কুসুম চাঁপা, গোলাপ ভুঁই চাঁপা ইত্যাদি।
মাটিতে জন্মানো অর্কিড বা ভুঁই অর্কিডের চমৎকার সংগ্রহশালা বলা চলে একে। এক পাতার দেশজ গ্রাউন্ড অর্কিড নারভিলিয়াসহ প্রায় ২০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ভুঁই অর্কিড রয়েছে বাগানটিতে।
আছে প্রায় ২১ প্রজাতির জবা, এডেনিয়াম, লিলি, স্বর্ণ চামেলী, হংসলতা, করবী, কুরচি, নীল মণিলতা, সাদা মণিলতা, মাংকি ফ্লাওয়ার, ফ্লেম ভাইন, টেকোমা, লাল কদম, রুদ্রাক্ষ,ব্যাটলিলি, ধলা বাঁদুর, ঝুমকালতাসহ দেশি-বিদেশি হাজারখানেক ফুলের গাছ।
কেবল স্থলজ গাছ নয়, জলজ গাছের মধ্যে পদ্ম, দেশি সাদা, নীল, লাল শাপলা, জল গোলাপ, সাদা কচুরিপানা,পন্ডেরিয়া, জেসমিন এরোহেড, জলজ হেলিকোনিয়া, জলজ লজ্জাবতী, পানিফল, ওয়াটার পপি, চাঁদমালা, থাইল্যান্ডের কয়েক রকম শাপলা বাগানটির জৌলুস বাড়িয়েছে।
ডা. আবু নাঈম জানান, ‘ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করেছি বাগানটি নিয়ে। সরকারি চাকরির কারণে নানা জায়গায় কাজ করেছি। ছাত্র জীবনেও পড়াশোনার অনেক চাপ ছিল। তারপরও বাগানের নেশা ছাড়তে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আয়ের অনেক সুযোগ আছে, এখন গাছ বিক্রি করেও উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারপরও আমি ওসবে যাব না। বাগানের প্রতি ভালোবাসা, বাগান নিয়েই থাকতে চাই।’
কুমিল্লার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মো. নুরুল করিম জানান, ‘আবু নাঈম একজন চিকিৎসক। তারপরও তিনি ব্যতিক্রম কাজ করছেন। এটি প্রশংসনীয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ডাক্তার নাঈমের মতো অন্যদেরও এগিয়ে আসা উচিত।’
নদী বন্দর / জিকে