এশিয়ার মধ্যে বড় হাওর মৌলভীবাজারের হাকালুকি। পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এই হাওরের মালাম বিল লিজ নেয় একটি প্রভাবশালী মহল। সেখানে যাওয়া-আসার রাস্তা ও বিলের বাঁধ তৈরি করতে ২০ হাজার হিজল-করচ গাছ কেটে ফেলা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকামের পর এ ঘটনায় মামলা দায়েরও হয়েছে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করায় প্রশ্ন উঠেছে কারা তাহলে এই গাছ কাটল? যদিও এর পেছনে কয়েকজন প্রভাবশালী জড়িত বলে প্রথম থেকেই আলোচনায় উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৎস্যজীবীর নামে বিলের লিজ থাকলেও এখানে বিনিয়োগ করেছেন বড়লেখা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একেএম হেলাল উদ্দিন ও তার নেতৃত্বে স্থানীয় ৮ প্রভাবশালী। তাদের ইন্ধনে জলজ গাছগুলো কাটা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ছোট ছোট এই গাছগুলো কাটার প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে ট্রাক্টরের মাধ্যমে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
গাছগুলো ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ এবং ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ও একাধিক এনজিওর সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতর সৃজন করে। তার মধ্যে ২০০৬ থেকে এখানে হিজল-করচ বনায়নে কাজ করে এনজিও সংস্থা সিএনআরএস।
সিএনআরএস’র তখনকার সমন্বয়কারী তৌহিদুর রহমান জানান, হিজল-করচ গাছ খুব ধীরে ধীরে বড় হয়। এই কারণে একটি গাছ রোপণের পর থেকে তা বড় করে তোলা পর্যন্ত গড়ে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়।
গাছ কাটার এ ঘটনায় গত ৩০ মে হাকালুকি ইসিএ ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য ও জলজ বনের পাহারাদার মো. আব্দুল মনাফ বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের অনুলিপি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী, পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসককে দেয়া হয়।
রহস্যজনক কারণে প্রধান অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ও আইনি পদক্ষেপ দেননি সংশ্লিষ্টরা। এতে হাওর পাড়ের সাধারণ মানুষ ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ৩০ মে অভিযোগ দায়ের হলেও তা প্রকাশ না হওয়ার চেষ্টা করেন অভিযুক্ত প্রভাবশালীরা। যদিও বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সামনে এসেছে এবং ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ মে থেকে ইজারাদারের লোকজন বিলের বাঁধ নির্মাণের নামে বিলের পাড়সহ ১২ বিঘা জমির প্রায় ২০ হাজার গাছ অবৈধভাবে কেটে ফেলে। এরপর তারা সেখানে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করে গাছগুলো মাটির নিচে মিশিয়ে দেয়। এতে হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
হাকালুকি হাওরের অন্তর্ভুক্ত বড়লেখা উপজেলার অধীনে মালাম বিলের (মৎস্য জলাশয়) আয়তন ৪২৮.৯২ একর। ১৪২৭ বাংলা হতে ১৪৩২ বাংলা সন পর্যন্ত সময়ের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ২১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৪৩ টাকায় মালাম বিলটি ইজারা নিয়েছে বড়লেখা উপজেলার মনাদি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি।
মনাদি মৎস্যজীবী সমিতির পরিচালক জয়নাল উদ্দিন বলেন, ‘জলমহাল ইজারায় শুধুমাত্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নাম ব্যবহার করা হয় তা সবাই জানেন। প্রভাবশালীরা বিনিয়োগ করেন এখানে। এক আওয়ামী লীগ নেতাও বিনিয়োগ করেছেন।’
তবে কে সেই প্রফেসর জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি।
এরই মধ্যে মঙ্গলবার (২২ জুন) রাত ১১টার দিকে বড়লেখা থানায় পরিবেশ অধিদফতর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মনাদি মৎস্যজীবী সমিতির পরিচালককে প্রধান আসামি করে সাত জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। মামলায় ১৫ থেকে ২০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়েছে।
মামলার পর মনাদি মৎস্যজীবী সমিতির পরিচালক জয়নাল উদ্দিনের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ। আমাদেরকে মামলা দেয়া হয়েছে। আমরা শুধু কাগজে কলমে আছি।’
কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন এখানে বিনিয়োগ করেছেন হেলাল উদ্দিনসহ স্থানীয় ৮ প্রভাবশালী। তাদের প্রয়োজনে এবং ইন্ধনেই গাছ কাটা হয়েছে।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলীর বক্তব্যেও উঠে এসেছে হেলাল উদ্দিনের নাম।
ইউএনও বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা তদন্ত করছি। যেহেতু অভিযোগ পেয়েছি আশেপাশের ইজারাদাররা এই কাজ করেছে, সেই হিসেবে এর পাশের ইজারাদার হেলাল উদ্দিনকে আমরা ডেকেছিলাম। তিনি তদন্তে সহযোগিতা করবেন বলেছেন। একইসঙ্গে তিনি নিজ থেকেই বলেছেন ৫ হাজার গাছের চারা তিনি কিনে দেবেন। আমরা তদন্তের আগে কাউকে অভিযুক্ত করতে পারছি না। তবে পরিবেশ অধিদফতরের মামলায় মৎস্যজীবী ছাড়া আর কারও নাম নেই।’
মামলার বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা বলেন, ‘আমরা সাত জনের নাম দিয়েছি এবং অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জন রেখেছি। কিছু প্রভাবশালীর নাম আমাদের কানেও এসেছে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। প্রমাণ পেলেই মামলায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
এদিকে সব অভিযোগ অস্বীকার করে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি পাঁচ-ছয় বছর আগে বিল ইজারার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এখন আর নেই। গাছ কেটেছে আশপাশের মানুষ। এতে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।’
৫ হাজার গাছ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকার ঘটনা তাই আমি ইউএনও অফিসে উপস্থিত ছিলাম। সে সময় অভিযুক্তদের বলি তোমরা গাছ লাগিয়ে দিও। এর বাইরে আর কিছু বলিনি।’
এদিকে, বুধবার (২৩ জুন) দুপুরে বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল উদ্দিন। মঙ্গলবার এবং বুধবার দুপুরে সহকারী কমিশনার ভূমির কার্যালয়ে তাকে ধরনা দিতে দেখা যায়। ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তিনি জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন।
এ বিষয়ে কমিশনার (ভূমি) নূসরাত লায়লা নীরা বলেন, ‘তিনি এসেছিলেন অন্য কাজে। মঙ্গলবার ও বুধবার দুপুরেও এসেছিলেন। আমরা এই ব্যাপারে খুব শক্ত অবস্থানে আছি। তাই কোনো লবিংয়ের কিছু ঘটেনি। সরেজমিনে মালাম বিলের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যা পাব তাই রিপোর্টে উঠে আসবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
পরিবেশ অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন ইবিএ প্রজেক্টের এডমিন অ্যান্ড ফিন্যান্স কর্মকর্তা (এএফও) সাহিদ আল শাহিন বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে ইসিএভুক্ত মালাম বিল এলাকায় প্রায় ৭০ একর জায়গায় হিজল-করচসহ পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানো হয়েছিল। গাছগুলো অনেক বড় হয়েছিল। এ ঘটনায় পাহারাদার থানায় ও ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। ইসিএভুক্ত এলাকায় সরকারি অনুমোদিত প্রকল্প ব্যতীত গাছ কাটা, খনন, স্থাপনা নির্মাণ, পাখি শিকার করা ইত্যাদি বেআইনি। গাছগুলো কাটায় হাওরের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা। প্রাণ ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘এশিয়ার সবচেয়ে বড় হাওরের ২০ হাজার হিজল, করচ, বরুণ গাছ কেটে ফেলা ভয়ঙ্কর পরিবেশ সঙ্কট তৈরি করবে। এতে মালাম বিলের জলজ বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্য শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে। হিজল, করচ, বরুণ গাছ হাওরের মাছ, পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। হাওরবাসীর আশ্রয়স্থল এই গাছ। মাছের খাদ্য তৈরি হয় হিজল গাছে। এসব গাছ হাওরে ধানের আবাদকেও সহায়তা করে। অনেক ঔষধি ব্যবহার আছে এইসব জলাবৃক্ষের।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি ইসিএ এলাকার এত গাছ কেটে ফেলা হলো হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড, বনবিভাগ, প্রশাসন কি করল? একদিনে এত গাছ কাটা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যেখানে সুন্দরবন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন সেখানে দেশের সবচেয়ে বড় হাওরের গাছ কেটে ফেলা অন্যায়। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যত দ্রুত পারা যায় মালাম বিলে আবারও হিজল, করচ, বরুণ লাগানো ও সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করতে হবে। এই বিলের লিজ বাতিল এবং হাওর বিল লিজের ব্যাপারে নতুন করে ভাবার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘পরিবেশমন্ত্রীর নিজ উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনে এতগুলো গাছ কাটার খবর হতাশার। এভাবে গাছ কেটে ফেলা ও তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ হাজার চারা দেয়া হাস্যকর। কারণ একটি চারার দাম হয়তো ২০-২৫ টাকা কিন্তু একটি গাছকে ৪/৫ ফুট করে বড় করে তুলতে খরচ হয় ৩-৪ হাজার টাকা এবং সময় লাগে কয়েক বছর।’
তিনি আরও বলেন, ‘সারাদেশে ইজারার নামে মৎস্যজীবীদের নাম ব্যবহার করে প্রভাবশালীরা বিনিয়োগ করে। পরে বিনিয়োগের টাকা তুলে আনতে তারা পারলে মাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। তাই ইজারার আইনে পরিবর্তন করা উচিত। মালাম বিলের ইজারা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।’
এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘জায়গাটি পরিবেশ অধিদফতরের অধীনে। তাই আমরা জেনেও কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পরিনি। তবে ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরিবেশ অধিদফতরকে জানিয়েছি। আমরা মৌখিকভাবে যে অভিযোগ পেয়েছি তাতে হেলাল উদ্দিনের নাম উঠে এসেছে। যদিও আমরা তা যাচাই করিনি।’
নদী বন্দর / এমকে