মৃত্যু পরবর্তী জীবনে মানুষ দুনিয়ার হিসাব-নিকাশ দেবে। সেখানে নিজ নিজ কৃতকর্মের ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কোনো সাহায্যকারী থাকবে। অপরাধীরা সেখানে ৯টি আক্ষেপ, অনুশোচনা ও আকাঙক্ষা করবে। কিন্তু সেদিন তা কোনো কাজে আসবে না।
কেননা এ কথাগুলো সত্য ও সুস্পষ্ট যে, জন্মের পর মানুষের মৃত্যু হবে সুনিশ্চিত। পরকালে মানুষের দুনিয়ার জীবনের বিচার-ফয়সালা অনুষ্ঠিত হবে, তাও সুনিশ্চিত। তারচেয়ে আরও বেশি সুনিশ্চিত যে, মৃত্যুর পর মানুষ আর দুনিয়ায় আসতে পারবে না।
সুতরাং পরকালীন জীবনে মানুষ যে আক্ষেপ, অনুশোচনা ও আকাঙ্ক্ষা করবে, আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমেই তা তুলে ধরেছেন। যাতে মানুষ এসব বিষয়ে সতর্ক হতে পারে। নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে পারে। পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে সফলতা লাভ করতে পারে।
কেননা মৃত্যুর পর মানুষের এসব আক্ষেপ, অনুশোচনা কিংবা আকাঙক্ষার কোনো মূল্য নেই। তাই পরকালের সুন্দর ও সফল জীবন লাভে কুরআনে বর্ণিত মানুষের মৃত্যু পরবর্তী ৯ আক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
– মাটি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা
মৃত্যুর পর নিজেদের আমলনামা তথা কৃতকর্ম দেখে অবাধ্যতাকারীরা ভয় পেয়ে যাবে। আর মৃত্যু যন্ত্রণা ও আজাব থেকে বাঁচতে আকাঙ্ক্ষা করবে-
– ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَن شَاء اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآبًا – إِنَّا أَنذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِي كُنتُ تُرَابًا
‘এই দিবস (পরকাল) সত্য। অতপর যার ইচ্ছা, সে তার পালনকর্তার কাছে ঠিকানা তৈরি করুক। আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম, যেদিন মানুষ প্রত্যেক্ষ করবে যা সে সামনে (মৃত্যুর আগে) পাঠিয়েছে।
আর (সেদিন তা দেখে) কাফেররা বলবে- ‘হায়, আফসোস! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।’ (সুরা নাবা : আয়াত ৩৯-৪০)
– নেক কাজ করার আক্ষেপ
দুনিয়াতে যারা পরকালকে অস্বীকার করতো। পরকালের নেয়ামতের বিষয়টি বিশ্বাস করতো না, তারা পরকালের জন্য নেক করতে না পারার জন্য মনে প্রাণে আক্ষেপ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا – وَجَاء رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا – وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى – يَقُولُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي – فَيَوْمَئِذٍ لَّا يُعَذِّبُ عَذَابَهُ أَحَدٌ – وَلَا يُوثِقُ وَثَاقَهُ أَحَدٌ
‘এটা অনুচিত। যখন পৃথিবী চুর্ণ-বিচুর্ণ হবে আর আপনার পালনকর্তা ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবেন। এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু এই স্মরণ তার কি কাজে আসবে?
সে (আক্ষেপ করে) বলবে- ‘হায়, এ জীবনের জন্যে আমি যদি কিছু আগে পাঠাতাম!’
সেদিন তার শাস্তির মত শাস্তি কেউ দেবে না। আর তার বন্ধনের মত বন্ধনও কেউ দেবে না।’ (সুরা ফাজর : আয়াত ২১-২৬)
> আমল বা হিসাবের পরিবর্তে মৃত থাকার আকাঙ্ক্ষা
মুমিন মাত্র ডান হাতে আমলনামা আকাঙক্ষা করবে। কিন্তু অপরাধী অবিশ্বাসী লোকেরা পরকালে বাম হাতে আমল নামা পেয়ে আকাঙ্ক্ষা করবে, আমলনামা না পাওয়ার, হিসাব না পাওয়ার এমনকি পরকালে যেন তারা মৃত অবস্থায় থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيهْ – وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيهْ – يَا لَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ
যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবেঃ হায় আমায় যদি আমার আমল নামা না দেয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়, আমার মৃত্যুই যদি শেষ হত।’ (সুরা হাক্বকাহ : আয়াত ২৫-২৭)
তারপরই দুনিয়ার ব্যাপারে আফসোস করবে, হা-হুতাশ করবে। আর জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এসব বলতে থাকবে-
مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيهْ – هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيهْ – خُذُوهُ فَغُلُّوهُ – ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ – ثُمَّ فِي سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُونَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوهُ – إِنَّهُ كَانَ لَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ – وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ – فَلَيْسَ لَهُ الْيَوْمَ هَاهُنَا حَمِيمٌ – وَلَا طَعَامٌ إِلَّا مِنْ غِسْلِينٍ – لَا يَأْكُلُهُ إِلَّا الْخَاطِؤُونَ
‘আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো উপকারে এলো না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল। ফেরেশতাদের বলা হবে- এদের ধর, গলায় বেড়ি পড়িয়ে দাও। অতপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতপর তাকে শৃঙ্খলিত কর, সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। নিশ্চয় সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না। আর মিসকিনকে খাবার দিতে উৎসাহিত করত না। অতএব, আজকের দিন এখানে তার কোনো সুহূদ নেই। আর কোনো খাদ্য নেই, ক্ষত-নিঃসৃত পুঁজ ব্যতিত। গোনাহগার ব্যতিত কেউ এটা খাবে না।’ (সুরা হাক্বকাহ : আয়াত ২৮-৩৭)
> রাসুলের পরিবর্তে অন্যদের বন্ধু করার আফসোস!
অবিশ্বাসীরা পরকালের ভয়াবহ পরিণতি দেখে আফসোস করে বলবে- আমরা কেন দুনিয়াতে নবুয়তের স্বীকৃতি দেইনি? রাসুলকে বাদ দিয়ে আমরা যদি অন্যকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম তবে আমাদের এ করুণ পরিণতি হতো না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا
হায়, আমার দূর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।’ (সুরা ফুরকান : আয়াত ২৭-২৮)
> রাসুলের আনুগত্য করতে না পারার আফসোস!
إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا – خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَّا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا – يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا
নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে জলন্ত অগুন (জাহান্নাম) প্রস্তুত রেখেছেন। তথায় তারা অনন্তকাল থাকবে এবং কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। যেদিন আগুনে তাদের মুখমণ্ডল ওলট-পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে-
হায়। আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রসূলের আনুগত্য করতাম। ( সুরা আহজাব : আয়াত ৬৪-৬৬)
সেদিন এসব অবিশ্বাসীরা আল্লাহর কাছে তাদের নেতা তথা পথভ্রষ্টকারীদের ব্যাপারে অভিযোগ করবে আর তাদের দ্বিগুণ শাস্তির আবেদন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا – رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا
‘তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা,! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের মহা অভিসম্পাত করুন।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৬৭-৬৮)
> রাসুলের অনুসরণের আকাঙ্ক্ষা
অবিশ্বাসীরা বিশ্বনবির অনুসরণ না করে তাদের নেতাদের অনুসরণ করার কারণে পরকালে আফসোস করবে। আর বলবে, আমরা দুনিয়াতে কেন বিশ্বনবিকে অনুসরণ করিনি! সেদিন তারা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবলম্বন করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে বলবেন-
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا
জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে-
হায় আফসোস! আমি যদি রসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম।’ (সুরা ফুরকান : আয়াত ২৭)
> সফলতা লাভের আকাঙ্ক্ষা
দুনিয়াতে মুমিনরা বিপদাপদে পড়লেই কিছু অবিশ্বাসী বলে বেড়াতো যে, আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন, আমরা বিপদে পড়িনি। অথচ তারা সঠিক পথের অনুসারী ছিল না। তারাই পরকালে সফলতা লাভের আকাঙ্ক্ষা করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَإِنَّ مِنكُمْ لَمَن لَّيُبَطِّئَنَّ فَإِنْ أَصَابَتْكُم مُّصِيبَةٌ قَالَ قَدْ أَنْعَمَ اللّهُ عَلَيَّ إِذْ لَمْ أَكُن مَّعَهُمْ شَهِيدًا
‘আর তোমাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ রয়েছে, যারা অবশ্য বিলম্ব করবে এবং তোমাদের উপর কোনো বিপদ উপস্থিত হলে বলবে, আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে যাইনি।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৭২)
আর যখনই সঠিক পথের অনুসারীরা নেয়ামত লাভ করতো তখন অবিশ্বাসীরা এমনভাব দেখাতো যে, তাদের সঙ্গে সঠিক পথের অনুসারীদের কোনো বিরোধিতা ছিল না। তারাই পরকালের ভয়বাহ সময়ে আল্লাহর কাছে সফলতা লাভের আকাঙক্ষা করবে। আল্লাহ বলেন-
وَلَئِنْ أَصَابَكُمْ فَضْلٌ مِّنَ الله لَيَقُولَنَّ كَأَن لَّمْ تَكُن بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ مَوَدَّةٌ يَا لَيتَنِي كُنتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا
পক্ষান্তরে তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো অনুগ্রহ এলে তারা এমন ভাবে বলতে শুরু করবে যেন তোমাদের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে কোনো মিত্রতাই (বিরোধিতা) ছিল না। (তারা সেখানে বার বার এ আকাঙক্ষা করতে থাকবে)-
‘হায়, আমি যদি তাদের সঙ্গে থাকতাম; তাহলে আমি ও যে সফলতা লাভ করতাম।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৭৩)
> শিরক না করার আফসোস!
যারা দুনিয়াতে আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরিক করতো, তারা পরকালে দুনিয়ায় শিরক করার বিষয়টি স্মরণ করে বলতে থাকবে-
وَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا
সে বলতে লাগলো- হায়, আমি যদি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক না করতাম।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৪২)
> পুনরায় দুনিয়া আসার আকাঙ্ক্ষা
পরকালের ভয়াবহ বিপদাপদ দেখে অবিশ্বাসীরা বারবার তাদেরকে দুনিয়া পাঠানোর আবেদন করবে। যাতে তারা দুনিয়াতে এসে ভালো কাজ করে পরকালে সফলতা লাভ করতে পারে। সে কথা তুলে ধরে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَوْ تَرَىَ إِذْ وُقِفُواْ عَلَى النَّارِ فَقَالُواْ يَا لَيْتَنَا نُرَدُّ وَلاَ نُكَذِّبَ بِآيَاتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
আর আপনি যদি দেখেন, যখন তাদের জাহান্নামের উপর দাঁড় করানো হবে! তারা বলবে- কতই না ভাল হত! যদি আমাদের পুনরায় (দুনিয়া) পাঠানো হতো; তাহলে আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ (সুরা আনআম : আয়াত ২৭)
পরকালের কঠিন সময়ে সব অবিশ্বাসীরা এ আফসোস ও আকাঙ্ক্ষা এবং নিজেদের কর্মে অনুশোচনা করতে থাকবে। অবশ্য সেদিন এসব আকাঙ্ক্ষা, আফসোস ও অনুশোচনার কোনোটিই কাজে লাগবে না।
আল্লাহ তাআলা বিশ্ব মানবতার জন্য এ আক্ষেপ, অনুশোচনা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো কুরআনে তুলে ধরেছেন। যাতে তারা মৃত্যুর আগেই নিজেদের সঠিক পরিচালিত করতে পারে। হেদায়েত লাভ করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা বিশ্বমানবতার সব মানুষকে সঠিক দ্বীন বুঝার তাওফিক দান করুন। ইসলামের সঠিক লাভের তাওফিক দান করুন। সবাইকে ইসলামের সঠিক পথের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
নদী বন্দর / পিকে