দৈনন্দিন জীবনে হাঁটার গুরুত্ব সম্পর্কে যদিও কম বেশি অনেকেই জানে। তবে তা সত্ত্বেও কিছুটা আলসেমি এবং কষ্টের ভয়ে কিংবা কাজের ব্যস্ততার অজুহাতে অনেকেই হাঁটাহাঁটি এড়িয়ে চলতে চান। কিন্তু হাঁটা হলো সবচেয়ে সহজ ব্যায়াম। ছোট-বড় যে কেউ নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করতে পারেন।
তবে কিছু ক্ষেত্রে আবার রিকশায় বা গাড়িতে না উঠে হাঁটাকে অপমান বা লজ্জাজনকও মনে করে থাকেন অনেকে। আসলে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করার স্বাস্থ্যগত গুরুত্বকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই। ‘সুস্থ রাখতে দেহযন্ত্র, হাঁটাই হোক মূলমন্ত্র’ প্রতিপাদ্যে ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর ৯ জানুয়ারি পালন করা হচ্ছে ‘জাতীয় হাঁটা দিবস’।
অনেকেই মোটা হওয়ার জন্য অতিরিক্ত খাওয়াকে দায়ী করে থাকেন। আর এর প্রতিকার হিসেবে প্রথমেই খাওয়া কমিয়ে দিয়ে থাকেন। তবে এটি খুব কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নয় তা বলাই বাহুল্য। কারণ আমাদের শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়ার কারণে শরীরের ঘাটতি পূরণ করার জন্যে নির্দিষ্ট সময় পর ঠিকই খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।
আর খাওয়া কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। তাই আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা খাবারের সাথে যে ক্যালোরি গ্রহণ করছি তার সমান বা বেশি যেন আমাদের শরীর থেকে ক্ষয় করতে পারি। এই কাজটি করতে হাঁটাহাঁটি একটি উত্তম উপায়।
যাদের নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস নেই; তারা নিয়মিত হাঁটলে অতিরিক্ত ক্যালোরি শরীর থেকে ক্ষয় হবে। হাঁটাহাঁটি করলে রক্তে ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএল বাড়ে ও মন্দ কোলেস্টেরল বা এলডিএল কমে। খাওয়ার পরে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলে নিজেকে বেশ ঝরঝরে লাগে এবং পাচিত খাদ্যদ্রব্যও খুব সহজেই হজম হয়ে যায়।
এ ছাড়াও নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস থাকলে ক্ষুধাজনিত সমস্যাও দূর হয়ে যায়। হাঁটার ফলে গৃহীত খাবার হজম হয়ে গিয়ে পুনরায় ক্ষুধার সৃষ্টি করে যা শরীরের বিপাক ক্রিয়ার অনুপাত ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
তবে একদম ভরপেট খাওয়ার পরপরই হাঁটবেন না। একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপরে হাঁটাহাঁটি করুন। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্যাভাসের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা করাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন।
উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেও প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাঁটলে শরীরের পেশিতে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে রক্তের গ্লুকোজ কমে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক এর ঝুঁকিও হ্রাস পায়।
নিয়মিত হাঁটলে রক্তনালির দেয়ালে চর্বি কম জমে। তাই করোনারি হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি কমে। এ ছাড়াও মূল করোনারি রক্তনালিতে ব্লক থাকলেও নিয়মিত হাঁটার কারণে আশপাশের ছোট রক্তনালিতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। কমে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও।
স্তন ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও হ্রাস পায়। হাঁটার সময় হৃৎস্পন্দন আর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়ে। ফলে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে রক্ত সরবরাহ বাড়ে। এতে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই অঙ্গের কর্মক্ষমতা বাড়ে। এমনকি হাঁটার অভ্যাস থাকলে কিছুটা হলেও এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
হাঁটার সময় আমাদের মন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারে। এতে করে মন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে না। আর খোলামেলা উদ্যানে ভোরের আলোতে হাঁটতে পারলে মনে একধরনের প্রশান্তি কাজ করে। আর এই অভ্যাস পুরো দিনের কাজের জন্যে উৎসাহ বাড়াতে বেশ সাহায্য করে।
প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস রাখতে পারলে আমাদের শরীরের সকল কোষকলা সক্রিয় থাকে। ফলে প্রত্যেকটি কোষে বিশুদ্ধ রক্ত ও অক্সিজেন সঠিকভাবে পোঁছতে পারে। তাই নিয়মিত হাঁটার ফলে শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।
যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে অর্থাৎ যাদের খুব সহজে গভীর ঘুম হয় না; তাদের জন্যে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস বেশ ফলদায়ক। নির্দিষ্ট সময় ধরে হাঁটার ফলে শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয় এবং শরীরে ক্লান্তিবোধ হয়। এর ফলে শরীরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার তাড়না থাকে।
নিয়মিত হাঁটলে মস্তিষ্কে এনডর্ফিন, ডোপামিন, সেরোটোনিনের মতো ভালো অনুভূতি তৈরির রাসায়নিক নিঃসরণ বাড়ে। ফলে বিষণ্নতা কমে, মন-মেজাজ ভালো থাকে, রাতে ঘুম হয় চমৎকার।
শরীরের হাড়কে মজবুত ও পেশিকে দৃঢ় করে গড়ে তুলতে সুষম খাদ্যের পাশাপাশি সবারই ছোটবেলা থেকে হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো, সাঁতার, সাইক্লিং ইত্যাদি নিয়মিত অনুশীলন করা উচিত। এতে করে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ছোটবেলা থেকেই বেশ দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে।
তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ব্যায়ামগুলো করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে সবার হাঁটাহাঁটির অভ্যাসটি নিয়ম করে পালন করা উচিত। পাশাপাশি বেশি বয়সে হঠাৎ করে শারীরিক ব্যায়াম করতে গেলে শরীরের পেশীতে অনেকসময় ব্যথা অনুভব হয়।
এ কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করা অনেকের কাছেই অনীহার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে কিছুদিন একটু হাঁটার পরামর্শ দেওয়া হয়। নিয়মিত হাঁটার ফলে শরীরের পেশীগুলো কিছুটা নমনীয় হয়ে আসে। একে বলা হয় ওয়ার্ম আপ।
মনকে প্রফুল্ল রাখার ক্ষেত্রে হাঁটার অভ্যাস বেশ কার্যকর একটি অনুশীলন। নিয়মিত হাঁটার ফলে মনের দুশ্চিন্তা কমে গিয়ে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। ছাত্রছাত্রীদের জন্যেও হাঁটার অনেক সুফলতা আছে। অনেক বেশি পড়া মাথায় চাপের সৃষ্টি করতে পারে।
তাই অযথা মোবাইল গেমসে বা কম্পিউটারে সময় নষ্ট না করে হাঁটার অভ্যাস করলে পড়ায় মনোনিবেশ করতেও সুবিধা হয়। এ ছাড়াও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন অফিসে বা বাসায় একটানা বেশিক্ষণ চেয়ারে বসে থাকা না হয়। কিছু সময় পর পর চেয়ার ছেড়ে উঠে একটু পায়চারি করা বা হাত-পা নড়াচড়ার অভ্যাস রাখা খুবই প্রয়োজন।
বর্তমান সমাজ অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়াতে মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন আমাদের কাছে অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব যন্ত্রের প্রতি আমরা অনেক বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছি, যা আমাদের শরীরের জন্যে অসম্ভব ক্ষতিকর।
সময় থাকতেই আমাদের প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের শরীর, মন, আত্মীয়-স্বজন, সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব এসব দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। আর এসবের জন্যে প্রয়োজন সুস্বাস্থ্যের। আর শরীরকে যথাযথভাবে কর্মক্ষম রাখার জন্যে নিয়মিত হাঁটাহাঁটির কোনো বিকল্প নেই।
হাঁটার উপকার পেতে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন হাঁটুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাঁটতে হবে। একবারে ৩০ মিনিট হাঁটতে না পারলে ১০ মিনিট করে দিনে তিনবার হাঁটা যেতে পারে। হাঁটার জন্য সকাল বা বিকেলের একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন।
দ্রুত হাঁটুন যাতে ঘাম হয় ও নাড়ির স্পন্দন বাড়ে। হাঁটা শুরুর পর প্রথম কয়েক মিনিট এবং শেষ কয়েক মিনিট ধীরে হাঁটুন। এতে শরীর সহজে মানিয়ে নিবে। হাঁটার শুরুতে এবং শেষে একটু পানি পান করুন। ঢিলেঢালা আরামদায়ক পোশাক ও উপযুক্ত জুতা পরে হাঁটুন। সুস্থ, প্রাণবন্ত ও নীরোগ থাকুন।
নদী বন্দর / এমকে