বিদেশ ফেরত আব্দুর রহমান। তিনি গ্রিন মাল্টা চাষ করে বিদেশের কাজের সমপরিমাণ টাকা আয় করছেন দেশে বসেই। গত দুই বছর আগে থেকে তিনি গ্রিন মাল্টা চাষ শুরু করেন।
এখন তার বাগানের প্রতিটি গাছে গ্রিন মাল্টা নামের সুস্বাদু ফল ধরেছে এবং পাকা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিক্রিও হয়েছে কয়েকশত কেজি মাল্টা। তিনি সারাবছর এই বাগানের ভেতরে মাল্টা গাছের ফাঁকে ফাঁকে সবজি উৎপাদন করে বাড়তি লাখ টাকা আয় করছেন।
মাল্টা চাষি আব্দুর রহমানের বাড়ি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের চিনাকান্দি গ্রামে। তিনি জানান, প্রায় ১৯ বছর সৌদি আরবে একটি কোম্পানিতে চাকুরি করেছেন। প্রবাস জীবনে থেকে চাকুরি করে আশানুরূপ টাকা উপার্জন করতে পারেননি।
হঠাৎ মাটি ও মানুষের টানে চলে আসেন দেশে। তখন ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি। দেশের মাটিতে ফিরে এলেন তিনি। তখন মনে মনে চিন্তা করেন ভালোমানের ফসল উৎপাদন করে বিদেশের সমপরিমাণ টাকা উপার্জন করবেন।
বাড়ির পাশে রেকর্ডিয় পতিত জমি থাকায় মাল্টা চাষের পরিকল্পনা চেপে বসে মাথায়। এভাবে ভাবতে ভাবতে চলে যায় ৬ মাস। ওই বছরের জুন মাসে এই মাল্টা চাষ শুরু করতে পরামর্শ নিতে ছুটে যান বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে।
মাল্টা চাষে চান ভালো ফলন, চান সমৃদ্ধশালী কৃষি উন্নয়ন পরামর্শ। তার এই পরামর্শে বেশ আগ্রহ দেখে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা। তখন আব্দুর রহমানকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে স্থাপিত ‘মাল্টা ব্লক প্রদর্শনী’ নামে ২০০ গ্রিন মাল্টা গাছের চারা হাতে তুলে দেন।
মাল্টা বাগানের ভালোমন্দ দেখাশোনার দায়িত্বও দেয়া হয় একজন কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তাকে। আব্দুর রহমান এই সহযোগিতা পেয়ে খুবই আগ্রহের সাথে বাগানের কাজ শুরু করেন। অফিসের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্বে থাকেন ধনপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামছুল আলম বিধু।
মাল্টা গাছ রোপণের সাথে সাথে মাটি ভরাটসহ বাগানের চারিদিকে নিরাপত্তা রক্ষায় বেষ্টনি নির্মাণ করেছেন আব্দুর রহমান। বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ করতে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে তার লাখ টাকার উপরে। এই খরচের চিন্তা তার মাথায় রেখে নানা কৃষি উৎপাদন কৌশল কাজে লাগিয়ে মাল্টা বাগানের ভেতরে সবজি চাষ করেছেন। প্রথম বছর সবজি চাষে ভালো লাভ হয়েছে।
এখন সারাবছর বাগানের মাল্টা গাছের ফাঁকে ফাঁকে শসা, ঢেঁড়স, মরিচ, টমেটো, লাউ ইত্যাদি চাষ করে অনেক ফসল উৎপাদন করছেন। এই সবজি বিক্রি করেও ভালো টাকা পাচ্ছেন।
আব্দুর রহমান, দুই বছর আগে রোপণকৃত তার মাল্টা বাগানে ১৪০টি গাছে কাঁচা পাকা মাল্টা ঝুলে আছে। ফলের ভারে গাছ নুয়ে পড়ছে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আটকে রেখেছেন। প্রতিটি গাছে মাল্টা ধরেছে অন্তত ৩০ কেজি করে।
প্রতি কেজি পাইকারি হারে বিক্রি করা যায় ১৪০ টাকা দরে। বাজারে খুচরা প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। এই হিসেবে তার বাগান থেকে প্রতিবছর অন্তত ৬ লাখ টাকার মাল্টা পাইকারি হারে বিক্রি করতে পারবেন।
মাল্টা বাগানে এখন তার কোনো খরচ নেই। ফল ধরবে বছর বছর। এছাড়াও সবজি বিক্রি করতে পারবে বছরে প্রায় ২ লাখ টাকার। মাল্টা চাষকে আরও সমৃদ্ধ করে বছরে অন্তত ২০ লাখ টাকা উপার্জনের পরিকল্পনা রয়েছে চাষি মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের।
সুনামগঞ্জ শহরের একাধিক মাল্টা ব্যবসায়ী জানান, বিশ্বম্ভরপুর এলাকায় উৎপাদিত মাল্টা রসে ভরা ও সুস্বাদু। আমরা বাইরে থেকে এনে হলুদ রঙের মাল্টা বিক্রি করি। স্থানীয় উৎপাদিত মাল্টা বিক্রি করার চিন্তায় আছি।
ধনপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামছুল আলম বিধু বলেন, আমি এই মাল্টা বাগানে ভালো উৎপাদনের জন্য প্রতিনিয়ত লক্ষ্য রেখেছি, পরামর্শও দিয়ে আসছি। এখন ভালো ফলন হয়েছে। রসে ভরা এই গ্রিন মাল্টা অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুঘ্রাণ রয়েছে। চাষি আব্দুর রহমানের আনন্দে আমিও আনন্দিত।
সুনামগঞ্জ বিনা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাকিব বলেন, আমরা খবর পেয়ে এখানে বাগান দেখতে এসেছি। এখন সরেজমিনে এসে দেখে আনন্দিত হয়েছি। পাহাড়ের কাছাকাছি এতো সুন্দর একটি বাগান মন চায় বাগানে বসে থাকি। মাল্টা চাষের উপযোগী মাটি থাকায় চাষি আব্দুর রহমানের এই মাল্টা বাগানে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. নয়ন মিয়া বলেন, চাষি আব্দুর রহমানকে মাল্টা চাষ করার জন্য আমরা ২ বছর আগে চারা দিয়েছিল। এখন আব্দুর রহমানের বাগানে মাল্টা ধরেছে। খুবই সুস্বাদু গ্রিন মাল্টা।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সাবেক কৃষি কর্মকর্তা দীপক কুমার দাস বলেন, আমি যখন ওই উপজেলায় ছিলাম তখনই বিদেশ থেকে ফিরে আসা ধনপুরের চাষি আব্দুর রহমানের এই মাল্টা চাষে আগ্রহ দেখে তাকে ২০০ গ্রিন মাল্টার গাছ দিয়েছিলাম। এখন শুনেছি বাগানে ভালো উৎপাদন হয়েছে। তার এই বাগান দেখে অন্যান্য চাষিরাও এই মাল্টা চাষ করতে উদ্বুদ্ধ হবেন।
নদী বন্দর / সিএফ