করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা থেকে বাদ যায়নি সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পও। সাড়ে চার মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার পর্যটনকেন্দ্রগুলো। এতে শত কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। ফলে ঋণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। তবে বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) থেকে পর্যটন খুলে দেয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার সংক্রমণ রোধে চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। চিরচেনা কুয়াকাটা স্থানীয়দের কাছেই এখন অচেনা। অথচ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটায় থাকতো হাজারও পর্যটকদের ভিড়।
কুয়াকাটায় হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, খাবার রেস্তোরাঁ, সৈকত সংলগ্ন শপিং মল, ট্যুর অপারেটরদের কার্যক্রম, ফটোগ্রাফি, ফিসফ্রাই, বিচ বাইকসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ১৬টি খাত বন্ধ রয়েছে। এজন্য আয়-রোজগার না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এসব খাতের সঙ্গে জড়িতরা।
হোটেল সী-প্যালেসের স্বত্বাধিকারী মো. আলমগীর বলেন, ঋণ পরিশোধে বিকল্প ব্যবসার চিন্তা করছি আমরা। আবার অনেকেই হোটেল বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে চাইলেও ক্রেতা সংটে তা পারছি না। কর্মচারীর বেতন দিতে পারছি না। একদিন পরে পর্যটন খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার। কতটুকু ঘাটতি পুষিয়ে উঠতে পারি তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
এদিকে, লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে এরইমধ্যে কয়েক শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতেও বাধ্য হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। তিন হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা আছেন তারাও ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। বেতন না পেয়ে অসহায় হয়ে চরম অর্থকষ্টে পড়েছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।
কুয়াকাটা ক্যামেরাম্যান সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস শেখ বলেন, কুয়াকাটা সৈকতে সংগঠন নিবন্ধিত প্রায় ১৮৬ জন ক্যামেরাম্যান রয়েছে। এরা কেউ স্টুডিও মালিকের কাছ থেকে দাদন নিয়ে আবার কেউ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ক্যামেরা কিনেছে। তাই বলা যায় প্রত্যেকটা লোকই এখন বড় ঋণ মাথায় নিয়ে আছে।
কুয়াকাটার ট্যুর অপারেটর নুর হোসেন আকাশ বলেন, করোনা মহামারির আগে কুয়াকাটায় দৈনিক প্রায় ৫ হাজার পর্যটক আসতেন। কর্মচারীদের বেতন ও সব খরচ বাদে দিনে ৫ হাজার টাকা আয় হতো আমার। ছুটির দিনগুলোতে আরও বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটতো। তখন আরও বেশি আয় হতো। এছাড়া প্রতি বছর দুই ঈদে লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম ঘটতো। কিন্তু এখন পুরো বিপরীত চিত্র।
রাখাইন মার্কেটের চয়েস ফ্যাশনের পরিচালক আলী হায়দার বলেন, বিগত সাড়ে চারমাস যাবত ব্যবসা বন্ধ। আমার ঋণ আছে ৩০ লাখ টাকার ওপরে। ব্যবসা প্রথমে ভালোই চলছিল। ঋণের কয়েকটা কিস্তিও দিয়েছি। সবকিছু ঠিক থাকলে এতদিনে শোধ হয়ে যেত। করোনায় সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। সময় মতো ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় টাকার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মচারীরা ছুটিতে আছে। তাদের বেতনও বন্ধ। নিজে খাবো নাকি কর্মচারীর বেতন দেব।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াকের) সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, কুয়াকাটায় এখনও পর্যাপ্ত পর্যটক নেই। স্থানীয় দর্শনার্থীরা এলেও ট্যুরিস্ট পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। একদিন পরে ১৯ তারিখ বিধিনিষেধ শেষ হবে। দীর্ঘদিন পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় আমরা মানবেতর জীবন-যাপন করছি। খোলার পরে কী পরিমাণ পর্যটক আসে তারপরে বলা যাবে আমাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কেমন সময় লাগবে।
তিনি আরও বলেন, ঈদ মৌসুমে আমরা লাভ-লোকসান হিসাব করে থাকি। দুই ঈদে টোয়াকের সেই হিসাব অনুসারে ৫০-৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোতালেব শরিফ বলেন, কুয়াকাটায় হোটেল-মোটেল রয়েছে প্রায় দুশ’র অধিক। প্রতি মাসে হোটেল খাতে ক্ষতি হচ্ছে সাত-আট কোটি টাকা। লকডাউনে কুয়াকাটার পর্যটন খাতে ১০০ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বারবার ধরনা দিয়েও ঋণের সুদ মওকুফসহ ব্যাংক থেকেও ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়নি।
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার বলেন, কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা মাসের পর মাস বেকার অবস্থায় আছেন। তাদের ৮০ শতাংশ মানুষের সংসার চালাতে ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে। তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়নি। পৌরসভায় ১০ টন চাল এসেছিল কিছু শ্রমিকের তালিকা করে সেই চাল থেকে ১০ কেজি করে দিয়েছি। কুয়াকাটার প্রত্যেকটা লোক তাকিয়ে আছে পর্যটকদের দিকে। ১৯ আগস্ট থেকে তাদের আগমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে।
নদী বন্দর / জিকে