সারি সারি গাছে ভরা সড়কের দুই পাশ। প্রায় ৩০ বছর আগে শিশু, কড়াই, মিনজুরি গাছ লাগানো হয়। সবুজেভরা পত্রপল্লব আর সুঠাম গাছগুলো শান্তির ঠিকানা ছিল হাজারো মানুষের। শিক্ষার্থীরা ছায়াঘেরা এ সড়ক দিয়েই যাতায়াত করতো মনের আনন্দে। ডালে ডালে বসতো হাজারো পাখি। মনের সুখে বাসা বেঁধে ফুটাতো ছানা। কিন্তু সবকিছুকেই উপেক্ষা করে তাজা গাছগুলো মৃত দেখিয়ে বিক্রি করে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।
এরপরই ঠিকাদার কেটে সাবাড় করছেন গাছগুলো। এখনো চলছে গাছ কাটা। গাছগুলো কেটে নেওয়ায় এখন খাঁ খাঁ করছে সড়কটি। ছায়াঢাকা সেই সড়কটি এখন মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। বলছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বেনীপুর-রহনপুর গ্রামের সড়কের কথা।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর নাচোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হলরুমে উপজেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ইউএনও সাবিহা সুলতানা। বিভিন্ন সড়ক, খাড়ির ধার ও পুকুর পাড়ে লাগানো গাছগুলো পরিপক্ক ও মরে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে সভাতে অবহিত করেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিএমডিএ’র নাচোল জোনের সহকারী প্রকৌশলী।
ওই সভার আলোচনা-২ এ সহকারী প্রকৌশলী বলেন, গাছগুলো দ্রুত কাটা না হলে ঝড়ে উপড়ে মানুষের জীবনহানি হতে পারে।
তার উত্থাপিত প্রস্তাবের ভিত্তিতেই গাছগুলোকে কাটার সিদ্ধান্ত দেয় পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি। এর মধ্যে নাচোল-আড্ডা সড়কের পার্শ্ববর্তী রাস্তা বেনীপুর থেকে রহনপুরা গ্রাম পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে ৬৩০টি শিশু, কড়ই ও মিনজুরি গাছ; গুঠইল গ্রামের সড়কের ৪০টি, নেজামপুর ইউনিয়নের ঝিনাইপুকুরের চারপাড়ে ১০৬টি শিশু গাছ, নেজামপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন পুকুরের চারপাড়ের ৩৪টি শিশু গাছ এবং ঝিকড়া হাজারবিঘা থেকে নামোঝিকড়া, হাজারবিঘী হতে ভাতসা সড়কের উভয়পাশের ৫২টি শিশু ও কড়ই গাছ রয়েছে।
এদিকে, উল্লিখিতস্থানগুলোর গাছগুলো কাটতে মূল্য নির্ধারণের জন্য ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় বিএমডিএ। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি গাছের মূল্য নির্ধারণ করে ও আইন মেনে গাছ পরিবহনের নির্দেশনা দেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আহম্মদ নিয়ামুর রহমান।
বন বিভাগের ওই চিঠিতে ৮৬০টি গাছের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে গাছগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে কিনেছে নওগাঁর মান্দা উপজেলার নাজিম স’ মিল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরেকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এদিকে অনেকটা গোপনে গাছ কাটার সব আয়োজন সম্পন্ন করে ঠিকাদারদের গাছ বুঝিয়ে দেয় বিএমডিএ’র নাচোল জোনের সহকারী প্রকৌশলী। এরপর তারা কয়েকদিন ধরে গাছ কাটছে। সব গাছ কেটে নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো এখন খাঁ খাঁ করছে।
কয়েকটি লটে ৮৬০টি গাছ মাত্র ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। গড়ে প্রতিটি গাছে দাম ধরা হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৬০০ টাকা।
গ্রামবাসী অভিযোগ করে বলছেন, বেনীপুর-রহনপুরা সড়কের একেকটি গাছে দাম অন্তত ১০ হাজার টাকা করে হতো। অথচ বিএমডিএ’র সহকারী প্রকৌশলীর যোগ-সাজশে মোটা মোটা গাছ পানির দরে বিক্রি করা হয়েছে। টাকার লোভে তারা পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে দিয়েছে। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয়রা আরও বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে বেনীপুর থেকে রহনপুরা গ্রামের কাঁচা সড়কটি নির্মাণ করা হয়। এরপর ওই সড়কের দু’ধারে গাছ লাগানো হয়েছিল। সেগুলোই এতদিনে বড় বড় গাছে রূপ নিয়েছে। দু’পাশের গাছের মগডালগুলো মিলিত হয়ে ছাতার মতো ছায়া দিতো সড়কের ওপর।
মাত্র ১০ শতাংশ হয়তো মরা গাছ ছিল। কিন্তু বাকি সতেজ ও সুঠাম গাছগুলোকেও কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি একদম খালি হয়ে গেল। চিরচেনা সেই রূপ হারিয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জোবায়ের বলেন, বিভিন্ন জায়গায় শত বছরের পুরোনো গাছ আছে এখনো। অথচ বেনীপুর-রহনপুরা সড়কে মাত্র ২৫-৩০ বছর বয়সী তাজা তাজা গাছ কেটে নেওয়া হলো। গাছগুলো কাটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কার স্বার্থে কাটা হলো-তা তদন্ত হওয়া উচিত।
বিএমডিএর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গাছ নিধনে ক্ষোভ প্রকাশ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন অনেকে। আবু সালেম লিখেছেন, ‘লুটের মহারাজ্য। ওদের খাবারে একটু টান পড়েছে, তাই গাছ দিয়ে মেটানোর চেষ্টা।’
এদিকে, উপজেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কাটা গাছের মোট দামের ন্যায্য হিসাব স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদকে দিতে হবে। অথচ এই নিয়মও মানেনি বিএমডিএ’র নাচোল জোনের সহকারী প্রকৌশলী শাহ মো. মঞ্জুরুল ইসলাম। ইউনিয়ন পরিষদের টাকার প্রাপ্য অংশও দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে নাচোল সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘ন্যায্য হিসাব দেওয়া তো দূরের কথা, আমাকে জানানোই হয়নি গাছ কাটার কথা। এই প্রথম শুনলাম গাছ কাটা হয়েছে। আমার এলাকায় গাছ কেটে সাবাড় করে দিলো অথচ আমিই জানতে পারলাম না! ইউএনওর কাছে বিএমডিএর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো’।
তবে বিএমডিএ’র নাচোল জোনের সহকারী প্রকৌশলী শাহ মো. মঞ্জুরুল ইসলাম দাবি করেন, গাছ মরে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। ঝড় হলে গাছ পড়ে প্রাণহানি ঘটতে পারে। এজন্য টেন্ডারের মাধ্যম কেটে নেওয়া হয়েছে। কোনো অনিয়ম হয়নি। আর ইউনিয়ন পরিষদকে তাদের ন্যায্য হিসাব পরিশোধ করা হয়েছে।
নাচোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা জানান, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গাছ কাটার সুযোগ নেই। বিএমডিএ মৃত গাছ কাটার কথাই বলেছিল। তবে তাজা তাজা গাছ কী কারণে কাটা হয়েছে এবং কাটা গাছের মূল্যেও ১০ শতাংশ হারে ইউনিয়ন পরিষদকে কেন দেয়া হয়নি তা খতিয়ে দেখা হবে।
বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ জানান, গাছ কাটার বিষয়ে আমি অবগত নই।
নদী বন্দর / বিএফ