করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের শিল্প কারখানাগুলোতে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই থাকছে না গ্যাস। একই সঙ্গে গ্যাসের চাপ কম থাকায় বন্ধ থাকছে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ক্যাপটিভ পাওয়ারগুলো। এতে চরমভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্প কারকাখানাগুলোতে।
এ নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন কারখানার মালিকরা। বিশেষ করে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে কারখানা চালু করেছিলেন তারা যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
বিভিন্ন শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় বড় কারখানায় ডিপিডিসির বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায় না। কারণ ডিপিডিসি’র বিদ্যুতের ভোল্টেজ আপ-ডাউন হয়। এর কারণে অত্যাধুনিক মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তাই নারায়ণগঞ্জের শিল্প কারখানাগুলো চালু রাখার জন্য প্রায় ১০০টি ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে। যা গ্যাস সঙ্কটের কারণে দিনের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকছে। ক্যাপটিভ পাওয়ারগুলো বন্ধ থাকায় চরম সঙ্কটে পড়ে যাচ্ছে পুরো পোশাক খাত।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, জ্বালানি হলো শিল্পের প্রধান চালিকাশক্তি। গ্যাস না থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ভর্তুকি দিয়ে হলেও পোশাক শিল্প তৈরি পোশাক এলএনজির আমদানি বাড়াতে হবে। পোশাক ও সুতাসহ রপ্তানিমুখী অধিকাংশ শিল্পে গ্যাসের স্বল্পচাপজনিত সঙ্কট এখন প্রকট। এ সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে। নতুবা সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে তাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৯০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ পাচ্ছে সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি ঘনফুট।
ফতুল্লার এমবি নীট ফ্যাশনের প্রোপ্রাইটর ও তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে আমাদের টেক্সটাইল খাতে বিশেষ করে স্পিনিং মিল এবং ডাইং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় মেশিনে মাল ওঠানোর পর যদি বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো পুনরায় ওঠানোর সুযোগ থাকে না। এ কারণে আমাদের টানা বিদ্যুৎ সরবরাহ লাগে। আমরা ডিপিডিসির বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারি না। বাধ্য হয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাতে হয়। ক্যাপটিভ পাওয়ার থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ওঠ-নামা করে না। ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চলে গ্যাসে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
হাতেম বলেন, নারায়ণগঞ্জে কমপক্ষে শতাধিক ইন্ডাস্ট্রিজে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। গ্যাস কম থাকায় এগুলো প্রায় সবসময় বন্ধ থাকছে। এভাবে চলতে থাকলে চরম সঙ্কটে পড়ে যাবে শিল্প কারখানাগুলো।
শহরের টানবাজার এলাকার হাজী হাসেম স্পিনিং মিলের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর নির্বাহী পরিচালক এম সোলাইমান বলেন, গ্যাস সরবরাহ একেবারেই কম। আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস দরকার সেটা পাই না। আমাদের এখান ১৫ পিএসআই চাপ দরকার আমরা পাচ্ছি ৫ থেকে ৬ পিএসআই। আমরা ক্ষতির মধ্যে আছি। যাদের বিদ্যুৎ আছে তারা কাজ করতে পারছে। আর যাদের বিদ্যুৎ নেই তাদের কাজকর্ম বন্ধ থাকে। সবাই সমস্যায় রয়েছে।
বাংলাদেশ নীট ডাইং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, সব জায়গায় গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে ছোট বড় মিলিয়ে চার শতাধিক ডাইং রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ টনের ক্যাপাসিটি সম্পন্ন ডাইং কারখানা রয়েছে। ৫০ টনের ক্যাপাসিটি সম্পন্ন ডাইংয়ের সংখ্যা বেশি। বড় ডাইংসহ অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি নিজস্ব বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে (ক্যাপটিভ পাওয়ারে) চলে। নারায়ণগঞ্জে শতাধিক ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে। বর্তমানে শিল্প মালিকরা গ্যাস সঙ্কটের কারণে দিশেহারা।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের অভাবে পাওয়ার প্ল্যান্ট চালানো যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের এখান থেকে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এটা এখন জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদিন এই সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। তবে তিতাস দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। হাজার হাজার অবৈধ লাইন রয়েছে। এটা সবাই জানে। এসব অবৈধ গ্রাহকরা শিল্পপতিদের ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্প উদ্যোক্তারা অবৈধ গ্রাহকদের কারণেই ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। এখন অবশ্য অনেক পরিবর্তন হয়ে আসছে। এই মাসের শেষের দিকে সমস্যা সমাধান হয়ে আসবে বলে আশা করছি।
এ বিষয়ে বিসিক শিল্পনগরী ফতুল্লার তিতাস গ্যাস অফিসের প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের দুই ধরনের গ্রাহক রয়েছে। একটি ধরন হলো কমার্শিয়াল গ্রাহক। এই লাইনে ছোট ও মাঝারি ধরনের শিল্প কারখানা চলে। দ্বিতীয় ধরনটি হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইন। এই লাইনে বড় বড় শিল্পকারখানা বিশেষ করে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো এই লাইনের গ্যাসে চলে। ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে ক্যাপটিভ গ্রাহকের সংখ্যা ৭৫। সাধারণ শিল্প গ্রাহক হচ্ছে ২৯২ জন। আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। এখন কী রকমের ঘাটতি আছে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
নদী বন্দর / জিকে