যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর গত এক মাস ধরে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। রপ্তানির অপেক্ষায় পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে ১০-২০ দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বন্দরে। ফলে বন্দর এলাকায় ট্রাকের দীর্ঘ সারি লেগেই আছে। এর প্রভাব পড়েছে আমদানিতেও। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও পথচারীসহ ভারতে পারাপার হওয়া পাসপোর্টযাত্রীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দরে রপ্তানির পণ্যবাহী ট্রাকের চাপে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জরুরি কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ ট্রাক পণ্য আমদানি কমে গেছে।
দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ‘নৈশ প্রহরী’ পরিচয়ে চাঁদাবাজির পরিমাণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। দাবিকৃত টাকা না দিলে মারধরের শিকারও হচ্ছেন অনেকে। এ অবস্থা উত্তরণে দ্রুত সময়ের মধ্যে রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বেশি রপ্তানি পণ্যের ট্রাক না নেওয়ায় এখানে যানজট দেখা দিয়েছে। এছাড়া হঠাৎ করে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় ও পণ্যবাহী ট্রাক বেশি আসায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পেট্রাপোল বন্দরের জায়গা সংকটের কারণ দেখিয়ে বেনাপোল বন্দর দিয়ে রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ভারত।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এ সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে। ভারত প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ৩৫০ থেকে ৪০০ ট্রাক পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করলেও বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা বরাবরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ভারত আগে ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাক রফতানি পণ্য গ্রহণ করলেও বর্তমানে ১০০ থেকে ১২০ ট্রাক রফতানি পণ্য গ্রহণ করছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা বিরাজ করলেও প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তিকে তা নিরসনে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।
দফায় দফায় আলোচনা করেও কোনো সুরাহা করা যায়নি যানজটের। এতে রপ্তানি বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিন এক একটি ট্রাককে পণ্য পরিবহনের ভাড়ার পাশাপাশি দুই হাজার টাকা করে ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে। সময়মতো এসব পণ্যবাহী ট্রাক গন্তব্যে যেতে না পারায় লাখ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশের রপ্তানিকারকরা।
বেনাপোল ট্রাক-লরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহীন বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে সয়াবিনের ভুসি, পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং গার্মেন্টস, সাবান, ব্যাটারি, গার্মেন্টস পণ্য ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিদিন এসব পণ্য নিয়ে ২০০-২৫০ ট্রাক ভারতে প্রবেশের জন্য বেনাপোল বন্দরে আসছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ১০০ থেকে ১২০টি ট্রাক গ্রহণ করছে। এ কারণে বেনাপোল বন্দর এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া বেনাপোল বন্দরে রপ্তানি পণ্যের ট্রাক রাখার কোনো টার্মিনাল নেই।
আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৫০ ট্রাক তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে দ্রুত রপ্তানি করা সম্ভব হলেও বর্তমানে যানজটের কারণে তা কঠিন রূপ নিয়েছে। এছাড়া ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি পণ্য গ্রহণে ধীরগতি নীতি অনুসরণ করায় রপ্তানি বাণিজ্যে সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। ফলে আমদানি করা পণ্য আসতে অনেক দেরি হচ্ছে।
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের মালামাল আমদানি হতো। বর্তমানে এই আমদানির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে। রপ্তানি পণ্য নিয়ে কয়েক হাজার ট্রাক সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দিনের পর দিন। বন্দরের এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি দেশে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের সংকট তৈরি হবে। বন্ধ হতে পারে শিল্প কলকারখানা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনই যদি দ্রুত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে যে কোনো সময় বন্ধ হতে পারে দুদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু বন্দরের অবকাঠামো বাড়েনি। রপ্তানি পণ্যের ট্রাক রাখার কোনো টার্মিনাল না থাকায় প্রধান সড়কসহ আশেপাশের সড়কে ট্রাক রাখার ফলে বেনাপোল বন্দর এখন কার্যত অচল। এছাড়া আগামী কয়েকদিন পর শুরু হবে দুর্গাপূজার ছুটি। এজন্য হঠাৎ রপ্তানি বেড়েছে। ভারত থেকে আসা ট্রাক বেনাপোল বন্দরের পার্কিংয়ে থাকলেও রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক রাস্তায় রয়েছে। যানজট কতদিন থাকবে তা বলা মুশকিল।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক মামুন কবির তরফদার বলেন, ভারতের পেট্রাপোল বন্দর হয়ে পণ্য আমদানি বাড়ার পাশাপাশি পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে। শত শত পণ্যবোঝাই ট্রাক ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় বেনাপোল বন্দর, বন্দরের আশেপাশে ও প্রধান সড়কে অবস্থান করছে। এতে বন্দর এলাকায় আমদানি-রফতানি পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি বাণিজ্য আরও গতিশীল করতে সম্প্রতি ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ওপারের টার্মিনালে জায়গা না থাকায় তারা বেশি ট্রাক নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এছাড়াও প্রতিদিন যাতে বেশি বেশি ট্রাক পণ্য ভারতে রফতানি করা যায় সে বিষয়ে আমরা রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমদানি বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াও।
তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় ট্রাকের চাপে আমদানি বাণিজ্যও কমে গেছে। এতে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
নদী বন্দর / সিএফ