এক জায়গায় দেখা মিলবে ৮৫ নদীর পানি। শুধু তাই নয়, জানা যাবে নদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নদী তীরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রার নানা ছবি ও তথ্য। বলা হচ্ছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত পানি জাদুঘরের কথা। এটিই এশিয়ার প্রথম পানি জাদুঘর। আর বিশ্ব এর অবস্থান সপ্তম। ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের অর্থায়নে ‘আভাস’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হয় এই জাদুঘরটি।
জানা যায়, নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের ৪৮৫ জন নারী ও পুরুষ মিলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আভাস এর উদ্যোগে গড়ে তোলেন একটি আত্ম-নির্ভরশীল সমাজ সেবা সংগঠন ‘উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘ’। এই সংগঠনের সদস্যরা মহাসড়কের পাশে পাখিমারা বাজার সংলগ্ন এলাকায় নিজেদের ১৫ শতাংশ জায়গা কিনে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলেন এ জাদুঘরটি।
উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘের সভাপতি মো. জয়নাল আবেদীন জানান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পানি প্রবাহে বাঁধা তৈরি করা ও অতিমাত্রায় পরিবেশ দূষণের কারণে নদীগুলো দিন দিন তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। পানির কৃত্রিম সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রভাব পড়েছে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক কাঠামোর ওপর। পানি, বায়ু ও সূর্যের রশ্মি হলো স্বীকৃত প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই এ সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এ জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়।
তিনি আরও জানান, পানিসম্পদের দিক বিবেচনায় মানুষের চিন্তার প্রসার ঘটানোর ব্যবস্থা করে জাদুঘরে প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন চিত্র, উপকরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম পানি জাদুঘর এটি। প্রথম দিকে দেখার জন্য প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা ভিড় করলেও এখন পর্যটকের সংখ্যা কম বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, জাদুঘরে প্রবেশ ফি শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা আর অন্যান্যদের জন্য ২০ টাকা। এখানে ঢুকলেই চোখে পড়বে সাদা কাঁচের বোতলে সারি সারি সাজানো দেশি-বিদেশি ৮৫টি নদীর পানি। যার মধ্যে নেপাল, ভারত, ভুটান, মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আন্তঃদেশীয় ৫৮টি নদ-নদীর পানি এবং ২৭টি দেশীয় নদ-নদীর পানি রয়েছে।
পানি জাদুঘরটি দেখতে আসা পর্যটক আসাদ বলেন. ‘আমি গৌরনদী থেকে কুয়াকাটা ঘুরতে আসছি, ফিরে যাওয়ার পথে এখানে ঢুকলাম। অনেকের মুখে শুনেছি কিন্তু আজ নিজে আসলাম। পানি জাদুঘরটি আসলেই একটি চমৎকার সংরক্ষণ। এটি দেখে আমি আনন্দিত। এখানে স্থান পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্মৃতিগুলো।’
জাদুঘরে গেলে যা দেখা যাবে
নানা ডিজাইনে সাজানো দোতলা টিনের ঘরের সামনে বালুর ওপর স্থাপন করা রয়েছে একটি নৌকা, যা শিকল দিয়ে নোঙর করা রয়েছে। বর্তমানে দেশে মানবসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীতে নৌকা আটকে থাকার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এতে।
ঘরটির দোতলায় প্রায় ৫০০ বর্গফুটের একাংশে সাদা বোতলের গায়ে নদীর নাম ঠিকানা লেখা রয়েছে। আর ভেতরে নদীর পলিসহ পানি দেখা যাবে। বিভিন্ন স্থানে সারি সারি সাজানো রয়েছে বাংলাদেশের হারানো ঐতিহ্য ও গ্রামীণ বাংলার মানুষের জীবিকা অর্জনের নানা উপকরণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-মাছ শিকারের নৌকা, চাঁই, ঝাঁকি জাল, খুচনি জাল, পল্লা, কাঁকড়া শিকারের চাঁই ও তাঁত বোনার মেশিন।
কৃষিজমির উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের জন্য বাঁশের তৈরি ডোলা, মুড়ি ভাজার তলছা, ঝারড়া, মাটির তৈরি রান্নার হাঁড়ি-পাতিল, মাটির তৈরি মাইড, খাবারের থালা ও বাসন, পিতলের তৈরি থালা, বাটি, বদনা, মগসহ নানান উপকরণ রয়েছে এই জাদুঘরে।
দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দেশীয় খাল, নদ-নদীর ছবি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জেলে এবং কুমার, তাঁতিসহ সব স্তরের মানুষের জীবনধারণ ও জীবিকা অর্জনের নানা শিল্পকর্ম।
পানি যাদুঘরের বর্তমান পরিচালক লিপি মিত্ত জানান, জাদুঘরটিতে এখন পর্যটকদের আনাগোনা আগের চেয়ে কিছুটা কম। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা থেকে প্রায় ১৭/১৮ কিলোমিটার দূরে হওয়ার কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা সব মানুষ এখানে আসেন না। তাই পানি জাদুঘরের জন্য কিছু জমি বরাদ্দ দিয়ে জাদুঘরটি কুয়াকাটার কাছাকাছি নেওয়ার ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কলাপাড়া আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মাননু জানান, জাদুঘরটির জন্য সড়কে একটি ভালো সাইনবোর্ড দেওয়া প্রয়োজন যেন রাতের বেলা দূর থেকে দেখা যায়। এছাড়া জাদুঘরটির আধুনিকায়নও প্রয়োজন। এই অঞ্চলের আরও ইতিহাস ঐতিহ্য এখানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী-খালের গবেষণামূলক তথ্য তুলে ধরার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের পানি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকাও প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আভাস এর নির্বাহী পরিচালক জাহিমা সুলতানা কাজল বলেন, ‘আমরা মানুষকে নদ-নদী সম্পর্কে সচেতন করতে ও পরিবেশ রক্ষায় এই উদ্যোগটা হাতে নিয়েছিলাম। আমরা বেশ সাড়া পেয়েছি। অনেক পর্যটক জাদুঘর দেখতে আসে। বর্তমানে কিছু সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ দরকার ছিল সেটিও আমরা অ্যাকশন এইডের সহযোগিতায় শুরু করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে যে জমিতে জাদুঘরটি রয়েছে এটি আসলে অস্থায়ীভাবে আমরা নিয়েছিলাম এখন যদি সরকার পানি যাদুঘরের জন্য কিছু জমি বরাদ্দ করে দেয় তাহলে আমরা জাদুঘরটি সেখানে নিয়ে স্থায়ীভাবে গড়ে তুলতে পারবো।’
নদী বন্দর / এমকে