১৯৭৭ সালে ২ অক্টোবর তথাকথিক বিদ্রোহ দমনের নামে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুতির ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানানো হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে তালিকা প্রকাশ না করলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বন্ধ করে দেওয়াসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন ‘১৯৭৭ সালে খুনি জিয়ার গুম ষড়যন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গ’।
সোমবার (৮ নভেম্বর) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে সংগঠনের সমন্বয়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমান মিঞার ছেলে মো. কামরুজ্জামান মিঞা লেলিন এই হুমকি দেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন।
বেলা ১১টার দিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর শতাধিক সদস্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মন্ত্রী তার দপ্তরে আসলে তিনি মন্ত্রণালয়য়ের নিচে তাদের কর্মসূচি স্থলে নামেন। নেমে তাদের কথা শোনেন।
এসময় হাবিবুর রহমান নামের একজন বলেন, ‘বাবা বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, বাবাকে কী নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাবা গামছা দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। আঙ্গুলগুলো খুলে খুলে গিয়েছে স্যার। পরে দুদিন পরে আবার দেখা করতে গেলে বাবাকে আর পাননি। লাশটাও আমরা পাইনি। বাবার কবরটাও জিয়ারত করতে পারছি না।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
ফাঁসি দেওয়া আরেকজনের পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘ফাঁসি দেওয়ার পর লাশটিও দেওয়া হয়নি। কেন নিলো, কী করলো আমরা কিছু জানি না। আমরা সরকারের সহায়তা চাই।’
আরেকজন বলেন, ‘আমার বাবার কী অপরাধ, আমার বাবা তো ছুটিতে ছিলেন। কেন তাকে বিনা অপরাধে ফাঁসি দিলো। আমি মাননীয় প্রধামন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। আমরা ৪৪ বছর ধরে শুধু কষ্টই করছি। আমরা যাতে ন্যায় বিচার পাই এটাই আমার দাবি।’
পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৭ সালে ক্যু এর নামে গর্বিত সদস্যদের কোর্ট মার্শাল ও কোর্ট মার্শাল ছাড়াই বিনা বিচারে হত্যা করার করুণ কাহিনী আমরা শুনলাম। শুনে আমি ব্যক্তিগতভাবে আবেগে আপ্লুত। ফাঁসি দেওয়ার পর লাশটাও পরিবারের কাছে দেয়নি। ফাঁসি হয়েছে না গুম হয়েছে- কোনো তথ্যই বেশিরভাগ পরিবারের সদস্যদের জানা নেই।’
তাদের বিচার চাওয়ার দাবির প্রতি আমি একাত্মতা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা, যুদ্ধাপরাধী ও জেলা হত্যার বিচার হতে পারলে, বিমান বাহিনীর সদস্যদের হত্যার বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি তাদের পরামর্শ দেই, তারা যদি তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে দেন তবে কীভাবে বিচার হয়েছে, কী অভিযোগ ছিল, সেই সমস্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করবো। এরপর জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই।’
তিনি বলেন, ‘একটা তদন্ত কমিশন করে এর একটা বিচার হওয়া উচিত। এ বিষয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি গোচর করবো। তাকে অবহিত করবো। আইনানুগভাবে কী করা যায় তা দেখবো। ওনারা জিয়াউর রহমানের নাম বলছেন, তার দায়-দায়িত্ব কতটুকু ছিল, তিনি কী ভূমিকা পালন করেছেন তা খতিয়ে দেখা হবে।’
সংগঠনের সমন্বয়ক কামরুজ্জামান মিঞা লেলিন বলেন, ‘১৯৭৭ সালে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে যারা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আমরা তাদের তালিকা চাই। তালিকা প্রকাশ না হলে আমরা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো। এমনকি আমরা সবাইকে নিয়ে সাতদিনের কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’
তিনি বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) ১২ বছর ক্ষমতায়। এই দায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী মহোদয়েরও। উনি ১২ বছর ক্ষমতায়, উনি দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার কর্নধার। কিন্তু ১৯৭৭ সালে যাদের হত্যা করা হলো, কারাদণ্ড দিলো, চাকরিচ্যুত হলেন তাদের একটা তালিকা উনি করলেন না।’
‘তাই আমরা কঠোরতর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো। এমনকি আজকে তো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করলাম। আমরা আলটিমেটার দিলাম, এরপর আমরা বন্ধ (মন্ত্রণালয়) করে দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমরা এই দেশের নাগরিক। ওই পতাকার অংশীদার আমার বাবা। কেন আমরা একটা লিস্ট পাবো না, বিচার পাবো না।’
উত্তেজিত হয়ে যখন লেলিন এসব কথা বলছিলেন, পাশে দাঁড়ানো মন্ত্রী তখন তার দপ্তরে যেতে লিফটের দিকে এগিয়ে যান।
নদী বন্দর / এমকে