ফরিদপুরে বিলুপ্তির পথে গরু দিয়ে হালচাষ পদ্ধতি। গরু, লাঙ্গল-জোয়াল দিয়ে জমি চাষাবাদ করা একেবারেই এখন আর দেখা যায় না। আধুনিক যুগে যন্ত্রচালিত পদ্ধতির কারণে মান্দাতা আমলের ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতি গ্রামবাংলা থেকে উঠে গেছে। কালের পরিবর্তনে সবকিছুর সঙ্গে এ কাজেও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।
ফরিদপুরের নয়টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এ দৃশ্য চোখে পড়া তো দূরে থাক, হঠাৎ কোনো মাঠে এর দেখা পেলেও নতুন প্রজন্মের কাছে এটি যেন এক নতুন কিছু।
খুব ভোরে কৃষকরা লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে করে এক জোড়া গরু নিয়ে বেরিয়ে যেত জমি চাষ করতে। ভোর থেকে দুপুর আবার কেউ সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে কৃষকের লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ, ভাটিয়ালি-পল্লীগীতি গানের মধুর সুর মাতিয়ে রাখতো গাঁয়ের মাঠ-ঘাট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষাণীরা অথবা পরিবারের কেউ সাজিয়ে নিয়ে যেত সকালের খাবার নাস্তা আলুভর্তা, ডাল, আটার রুটি, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তাভাত, যাউ ভাত। দুপুরে গরম ভাত। এমনই ছিল গ্রামবাংলার চিরাচরিত রূপ।
এখন যেন বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে সেই হালচাষের দৃশ্য। ফরিদপুরে এমন দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না বললেই চলে। সময়ের সাথে দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। বিজ্ঞানের অগ্রাযাত্রায় নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় বর্তমানে কৃষিকাজেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তাই তো কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে সিডার, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ নানান যন্ত্রপাতি।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এক সময় ফরিদপুরের সব উপজেলায় বাণিজ্যিক ও পারিবারিকভাবে কৃষক গরু পালন করতো হাল চাষ করার জন্য। আবার কিছু মানুষ গবাদিপশু দিয়ে হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন। অনেকে ধান, গম, তিল, সরিষা, কালাই, বেলি ও আলু চাষের জন্য ব্যবহার করতেন।
নিজের জমি চাষের পাশাপাশি অন্যের জমি চাষ করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন। হালের গরু দিয়ে দরিদ্র মানুষ জমি চাষ করে ফিরে পেত তাদের পরিবারের সচ্ছলতা। এখন দিনে-সপ্তাহে অথবা মাস ধরে ৩০-৪০ গ্রামের মাঠ ঘুরলেও এ দৃশ্য চোখে পড়বে কি না সন্দেহ।
জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে চাষাবাদ। তাই কৃষকরা এখন পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু দিয়ে হালচাষ।
বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের স্বপন বিশ্বাস, সুকুমার বিশ্বাস, মহানন্দ বিশ্বাস, সুনিল বিশ্বাসসহ একাধিক কৃষক বলেন, ছোটবেলায় বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসছি। নিজেরাও গরু দিয়ে হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হালচাষের বলদ গরু দু-তিন জোড়া থাকত। চাষের জন্য দরকার হতো এক জোড়া বলদ, কাঠ আর লোহার সমন্বয়ে তৈরি লাঙ্গল, জোয়াল, মই, হালো নাঠি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানোর লাঠি), গরুর মুখের টোনা (বাঁশের ও বেতের তৈরি)। আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো।
চাষের সময় গরুর গোবরের জৈব সার জমিতে পড়ত। এতে ক্ষেতে ফলন ভালো হতো। এখন আধুনিক যুগ, নতুন নতুন মেশিন এসেছে সেই মেশিন দিয়ে জমি চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া তাদের প্রত্যেক পরিবারে পাওয়ার টিলার আছে।
ফরিদপুর সদর, সালথা, নগরকান্দা, মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও ভাঙ্গা উপজেলার সজিব মোল্লা, সিদ্দিক মাতুব্বর, আকাশ সাহা, উচমান সেখ, সোহাগ মাতুব্বর, আলাউদ্দিন সেখ একই কথা জানান।
আগেকার দিনে বাপ-দাদার সময়কাল থেকে তাদের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত গরু দিয়ে হালচাষ করতেন। এখন কোনো কৃষকই এ পদ্ধতিতে জমি চাষ করেন না। তারা আরও জানান, সপ্তাহজুড়ে পুরো জেলা ঘুরে দু-একটা মাঠে এ দৃশ্যর দেখা মিলবে কি না সন্দেহ। অধিকাংশ কৃষকের চাষাবাদের জন্য এসব উপকরণ তো দূরে থাক গরুই নেই।
টোংরাইল, সুতালিয়া,মোড়া, চাপখণ্ড, তেঁতুলিয়া, কদমি, রুপাপাত, ভাবখণ্ড, পুতন্তীপাড়া গ্রামের কাঠমিস্ত্রি দেব কুমার শিকারী, স্বপন, কালি কুমার,হারাধন, বিষ্ণুপদ, নিখিল সরকার, অখিল, তারাপদ, শুশিল জানান, বাবলা, তেঁতুল কাঠ দিয়ে লাঙ্গল-জোয়াল তৈরি করতেন। তখন তাদের প্রধান পেশা ছিল লাঙ্গল-জোয়াল তৈরি করা। বাড়িতে বসে তৈরি করতেন।
এছাড়া আশপাশের সব হাট-বাজারে এগুলো বিক্রির নির্দিষ্ট স্থান ছিল। এখন এগুলোর চাহিদা শেষ। তারা সবাই এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় জড়িত। কোন হাট-বাজার অথবা ১০-২০টি গ্রাম ঘুরেও একজন লাঙ্গল-জোয়াল তৈরি করা মিস্ত্রি পাওয়া যাবে না। এসব উপকরণ কোথায় পাওয়া যায় তাও তারা জানেন না।
চলার পথে মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নের গাজনা-বেলেশ্বর মাঠে হঠাৎ চোখে পড়ে গরু দিয়ে হালচাষ পদ্ধতি। ওই গ্রামের কৃষক ইকলাস সেখ তিনি এই পুরোনো ঐতিহ্যটি এখন ধরে রেখেছেন।
জমির মালিক গোলাম ফারুক বলেন, বাপ-দাদার আমলের এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। এ মাঠে বেশিরভাগ জমি আমাদের। ভুট্টাসহ প্রায় সব ফসলের জমি লাঙ্গল দিয়ে চাষ করাই। পেঁয়াজ, রসুন, ধান, পাট, সরিষা, মসুরিসহ অন্যান্য সব ফসলের জমি এ ভাবে চাষ করান তিনি।
এ বিষয়ে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী বলেন, ফরিদপুর জেলায় মোট কৃষি আবাদের জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫১ হাজার ৪১৬ হেক্টর। বেশিরভাগ জমি এখন আধুনিক যন্ত্র দিয়ে চাষাবাদ করা হয়।
গরু দিয়ে হাল চাষ পদ্ধতি একেবারেই বিলুপ্তির পথে। তারপরও শতকরা এক থেকে দুই ভাগ কৃষক এ পদ্ধতিতে চাষবাস করেন। কিছু কৃষক মই দেওয়ার কাজে গরু ব্যবহার করেন।
নদী বন্দর / পিকে