হেমন্তের বিদায় বেলা আর শীতের আগমনী বার্তা। এই সময়ে গ্রাম অঞ্চলের খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড় ও ফসলি মাঠের পানি কমে গেছে। কম পানিতে মাছ ধরার ধুম পড়েছে সবখানে। এটা এক সময় উৎসব আর ঐতিহ্য ছিল যা এখন আগের মতো নেই। আগেরকার দিনে গ্রামবাসী দল বেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে উঠতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুরে ১১ হাজার ৫৫৩ হেক্টর আয়তনের পাঁচটি নদীতে বছরে মাছের উৎপাদন হয় তিন হাজার ৭৪৫ মেট্রিক টন। ২৯ জাজার ৮৩১টি পুকুর থেকে ২১ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন, ৭৯টি বিল থেকে ১০৬২ মেট্রিক টন, পাঁচটি বাওড় থেকে ৮১৩ মেট্রিক টন, ২৯০টি প্লাবনভূমি থেকে ৯ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন ছাড়াও ৭৯টি খাল, পাঁচটি হ্যাচারি ও অন্যান্য উৎস থেকে মাছের যোগান আসে।
এদিকে ফরিদপুর জেলা-উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অধিকাংশ নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, বাঁওড়ের পানি শুকিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও কাদা-পানি থাকা এসব খাল-বিলে রয়েছে নানা প্রজাতির দেশি মাছ।
জেলার নয়টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও বিলাঞ্চলে দেখা যায়, মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে নানা বয়সী মানুষের মিলনমেলা। দল বেঁধে মানুষ বিলে নেমেছে মাছ ধরতে। সবার চোখ-মুখে খুশির ঝিলিক। এ যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া সময়ের দৃশ্য।
পেশাজীবী জেলে থেকে শুরু করে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা এখন নেমে পড়েছে মাছ শিকারে। শীত মৌসুমেই গ্রামগঞ্জে মাছ ধরার এই চিত্র চোখে পড়ে। কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, পুঁটি, টেংরা প্রভৃতি দেশি মাছ ধরা পড়ে বেশি। তাছাড়া খইলসা, বোয়াল, চিকরা, বাইন, কাতলা, সিলভার কার্প প্রভৃতি মাছ তো রয়েছেই।
প্রতিটি গ্রামগঞ্জেই এখন মাছ ধরার উৎসব চলছে। ভোর হতে হতেই শুরু হয় মাছ ধরার পালা। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলেই মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠেন। খেপলা জাল, টাক জাল, ঠ্যালা জাল, প্রভৃতি নিয়ে এবং শিশু-কিশোররা খালি হাতেই খালে-বিলে নেমে পড়ে।
যেখানে হাঁটু পানি সেখানে হাত দিয়ে সেচের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর খালে-বিলে মাছ ধরছে মানুষ। দুপুর পর্যন্ত চলে মাছ ধরার এই প্রক্রিয়া। পরে নিজেদের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মাছ হাটবাজারে বিক্রি করে দেয়। আর মাছ ধরায় সামিল হতে পেরে শিশু-কিশোরদের আনন্দের যেন শেষ নেই। কাদা-পানিতে সারা শরীর মাখামাখি করে তারা মাছ ধরার আনন্দে বিভোর।
মধুখালী উপজেলার আড়পাড়া খালে পানি কমে যাওয়ায় সপ্তাহব্যাপী চলছে মাছ শিকার। শিশু-কিশোর, যুবকদের একত্রে মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ে।
এলাকার হেলাল উদ্দিন, শামসুল আলম সোনা, মাহবুব হোসেন জানান, কম-বেশি সবাই মাছ ধরতে পারছে। কেউ খালি হাতে ফিরছে না। এভাবে মাছ শিকার করার মধ্যে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়।
শহরতলীর কৃষ্ণনগর এলাকার সজিব মোল্লা বলেন, এটি গ্রামবাংলার অন্যতম ঐতিহ্য। কৃষ্ণনগর স্কুলপাড়া এলাকার বিলে শুকনো মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় মাছ ধরার প্রতিযোগিতা চলছে। এ যেন এক অন্যরকম আনন্দ।
সালথা উপজেলার বিধান চন্দ্র মন্ডল, গৌতম সাহা, আজগর আলীসহ অনেকেই জানান, বর্তমানে গ্রামগঞ্জের খাল-বিলে মাছ ধরার উৎসব চলছে। হাটবাজারে বেশি পরিমাণে মাছ পাওয়া যাচ্ছে এবং অন্যান্য সময়ের তুলনায় দামও এখন অনেক সস্তা।
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, এক সময় গ্রাম বাংলায় এভাবে মাছ শিকার করা উৎসব ছিল। এমন ঐতিহ্য আজ অনেকটা হারিয়ে গেছে। তারপরও এখন এ দৃশ্য চোখে পড়ে। জেলায় গত বছর মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪৩ হাজার ৫২১ মেট্রিক টন। যা চাহিদার তুলনায় দুই হাজার ২০১ মেট্রিক টন বেশি। জনপ্রতি ৬০ গ্রাম মাছের যোগান হিসেবে ফরিদপুরে মাছের চাহিদা রয়েছে ৪১ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন।
তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছর জেলার ৯টি উপজেলার উন্মুক্ত জলাশয়ে ৬ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন পোনা মাছ অবমুক্ত করা হয়েছে। সাড়ে ১৫ হেক্টরে প্রদর্শনী খামার করা হয়েছে। জেলায় মৎস্য চাষি রয়েছে ২০ হাজার ৭০০ জন। এদের মধ্যে নিবন্ধিত মৎস্য চাষি ১২ হাজার ১৮০। এছাড়া বেশকিছু মৎস্য উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে।
নদী বন্দর / বিএফ