চলনবিলসহ পাবনার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরের বিভিন্ন বিলে এখন চলছে বাউতদের ‘পলো উৎসব’। শনিবার(২৭ নভেম্বর) থেকে ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিল সৌখিন মাছ শিকারিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। এটা চলবে সপ্তাহ ধরে।
এক সময়ের মৎস্যভান্ডার খ্যাত চলনবিলে এখন মাছের আকাল থাকলেও বাউতদের (সৌখিন মৎস্য শিকারি) আনন্দের কমতি নেই। ‘চলো পলো নামি’ বলে দলে দলে বাউত নামছে বিভিন্ন বিলে খালে। তাদের পলোতে কম-বেশি বাহারি জাতের সব মাছ ধরা পড়ছে। বিলে মাছ ছেড়ে উৎসবটিকে জমজমাট করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন চাটমোহর উপজেলা প্রশাসন।
চলনবিল এলাকার রুহুল বিল, বিলকুড়ালিয়া, খলিশাগাড়ি, বড়বিলা, জিয়লগাড়ি, সানকিভাঙ্গা বিল, গুমানী, চিকনাই নদীতে মাইলের পর মাইলজুড়ে শত শত বাউত প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামছেন। এ যেন হারিয়ে যাওয়া উৎসব নতুন করে ফিরে পাওয়া।
এলাকায় রীতিমত মাইকিং করে খাল-বিলের পাড়ে ভোর না হতেই বিভিন্ন রকম ধ্বনি দিয়ে পলো হাতে বাউতদের নামতে দেখা যাচ্ছে। হাঁটুপানি কোথাও বা গলা পানিতে মাছ ধরছেন সৌখিন মাছ শিকারিরা। কিছু সৌখিন মানুষ চলনবিলপাড়ে নিকট আত্মীয়দের বাড়িতেই থাকছেন। সব মিলিয়ে এখন বিলপাড়ে এক ধরনের উৎসব আমেজ চলছে।
স্থানীয়রা জানান, পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার মন্ডুতোষ/ পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের কয়েক হাজার একর জমি নিয়ে রুহুল বিল। বর্ষার পানি চলে যাওয়ার পর কয়েকশ একর জমিতে বিভিন্ন গভীরতায় পানি থাকে। সেখানে বর্ষার পানিতে আটকে থাকে বোয়াল, শোল, গজার, পুঁটি, শিংসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ। মাছ শিকারিদের কেউ কেউ মাছ পান। আবার অনেকে মাছই পান না। কিন্তু আনন্দে মেতে ওঠেন সবাই। সব বয়সীর হাজার হাজার সৌখিন মাছ শিকারিদের আনাগোনায় রহুল বিল হয়ে ওঠে জমজমাট।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) ভাঙ্গুড়া উপজেলার রুহুল বিলে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় অনেকটাই পানিশূন্য বিল বুক চিতিয়ে দিয়েছে। মূল বিল, খালে কিছু পানি অবশিষ্ট রয়েছে। এ সময়ই এ এলাকার সৌখিন মানুষেরা যোগ দিয়েছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো উৎসবে।’
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে মানুষের ঢল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে এক স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সববয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। এরপর দলবেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠেন তারা।
এ উৎসবে পাবনা, নাটোর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসছেন। এদের হাতে পলো, চাক পলো, নেট পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জাল, লাঠি জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম চোখে পড়ে। বিলপাড়ে সমবেত হওয়ার পর একসাথে বিলে নেমে মাছ ধরার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছেন শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ।
মাছ পাওয়া, না পাওয়া তাদের কাছে বড় কথা নয়। ব্যতিক্রমী এ উৎসবে যোগ দিয়ে আনন্দ উপভোগই যেন তাদের কাছে মূখ্য। তবে অনেকেই বোয়াল, রুই-কাতলা, শোল মাছ শিকার করে বাড়ি ফিরেছেন আনন্দের সঙ্গে।
এ উৎসবে যোগ দিতে আসা নাটোরের পঞ্চাশোর্ধ্ব আলম হোসেন বলেন, রউল বিলে (রুহুল বিলে) মাছ ধরার জন্যে প্রতি বছর অপেক্ষা করে থাকি। লোক মুখে মুখে খবর পেয়ে মাছ ধরতে এসেছি।
টাঙ্গাইলের বাছের উদ্দীন বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে মাছ ধরার খবর পেয়ে তারা একাধিক বাস রিজার্ভ করে পলো ও মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে মাছ ধরতে এসেছেন।
ঈশ্বরদীর ৫৫ বছর বয়সী ময়েজ উদ্দীন জানান, পলো দিয়ে মাছ ধরা তার দীর্ঘদিনের শখ। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি বছরে চলনবিলের রুহুল বিলে চলে আসেন। তবে আগেকার তুলনায় দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নাটোর জেলা থেকে আগত মৎস্য শিকারি আবু বক্কার বলেন, মোবাইল ফোনে অন্য বাউৎদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই প্রতিবছর মাছ শিকার করতে আসি। মাছ পাই আর না পাই এটি বড় না, বড় হলো শখ।
চাটমোহরের ছাইকোলা ডিগ্রি কলেজের জীববিদ্যার সহকারী অধ্যাপক কাজী মান্নাফ জানান, চলনবিলের মাছ ধরার এই পলো উৎসব ছোটবেলায় আমি অনেক দেখেছি। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। পানিশূন্য বিলে মাছ নেই বললেই চলে। আর প্রায় সব বিলই তো এখন প্রভাবশালী অমৎস্যজীবীদের দখলে। সেখানে পলো ফেলা মুশকিল।
পাবনা জেলা মৎস্য অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, উন্মুক্ত জলাশয়ে সৌখিন মৎস্য শিকারিরা প্রতিবছরই মাছ শিকার করে থাকেন। উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে যেন মাছ থাকে সেজন্য প্রতি বর্ষা মৌসুমে উন্মুক্ত জলাশয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈকত ইসলাম জানান, বাউত বা পলো উৎসব গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। দেশের অন্যান্য এলাকায় এ উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এ এলাকায় ঐতিহ্যটি এখনো টিকে আছে। বড় বিল, ডেঙ্গার বিল, খলিশাগাড়ি বিল, রহুল বিল, ডিকশীবিলসহ অন্যান্য বিলে বাউতরা মাছ ধরছে। এ উৎসবটিকে জমজমাট করতে বিলে মাছ থাকা প্রয়োজন। এজন্য বর্ষার আগে বিলে মাছ ছেড়ে রেখে বর্ষার পর উৎসবটিকে ধরে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এজন্য তিনি পার্শ্ববর্তী বিল প্রধান কয়েকটি উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।
নদী বন্দর / বিএফ