একটা সময় ছিল যখন চরাঞ্চলে পণ্য আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো গরু ও মহিষের গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ি ছিলো রাজা-বাদশাহ ও জমিদারের পরিবহন। সেসময় ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি সাধারণ মানুষের কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কালের পরিক্রমায় সেই ঘোড়ার গাড়ি এখন প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মানুষের পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সাহেবের আলগা, জাহাজের আলগা, ঝুনকার চর, কালির আলগা, রলাকাটাসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল ঘুরে শত শত ঘোড়ার গাড়িতে করে মালামালসহ পণ্য আনা নেওয়ার এমন চিত্র দেখা গেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরাঞ্চলের মানুষের মালামাল পরিবহনসহ ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা নেওয়ার জন্য বর্তমানে একমাত্র মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি। জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে দীর্ঘতম নদনদীগুলির একটি ব্রহ্মপুত্র নদ। বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকাসহ চরাঞ্চলগুলো পানিতে তলিয়ে গেলে সেসময় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয় নৌকা। তবে শুষ্ক মৌসুমে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন চরাঞ্চলের মানুষ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানান, বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের বিশাল এলাকাজুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর। এ সময় চরাঞ্চলে বসবাসকারী কৃষকদের কৃষিপণ্য ও ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহনে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এসব চরাঞ্চল অন্য কোনো যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় ঘোড়ার গাড়িই একমাত্র মাধ্যম।
চরাঞ্চলে উৎপাদিত ফসল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। এক ঘোড়া দিয়ে ছোট ছোট মোটরের টায়ারের চাকায় চলে এসব গাড়ি। চরাঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কিছু কিছু জায়গা থেকে অনায়াসে চলতে পারলেও অনেক স্থানে গভীর বালু থাকায় গাড়ি যাতায়াতে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রতিটি গাড়িতে ১৫ থেকে ২০ মণ কৃষি পণ্য পরিবহন করা যায়। চরাঞ্চলের মানুষ ঘোড়ার গাড়িতেই বালু চর পেরিয়ে তাদের গন্তব্যে যাতায়াত করছে।
ঘোড়ার গাড়ি চালকরা জানান, সাধারণত মাইক্রোবাসের পুরনো চাকা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করেন তারা। প্রতিটি গাড়ি তৈরি করতে খরচ পড়ে ১২-১৪ হাজার টাকা। একটি ঘোড়া কিনতে লাগে আরও ২৫-৩০ হাজার টাকা। সারাদিনে আয় হয় ৬০০-৮০০ টাকা। তা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণসহ সংসারের অনান্য খরচ বহন করেন তারা।
চরাঞ্চলে বালুর গভীরতা বেশি থাকায় অনান্য যানবাহন চলাচল করতে পারে না। ফলে মালামাল পরিবহনে ঘোড়ার গাড়িই একমাত্র বাহন।
যাত্রাপুর হাটের কৃষিপণ্য মজুত ব্যবসায়ী মুকুল মিয়া বলেন, কুড়িগ্রাম জেলার সাহেবের আলগা, জাহাজের আলগা, ঝুনকার চর, কালির আলগা, রলাকাটাসহ বিভিন্ন চরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আমার কাছ থেকে ধান, গমসহ অনান্য কৃষিপণ্য কিনে ঘোড়ার গাড়িতে যাত্রাপুর নৌকা ঘাটে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে নৌকায় করে নিজ নিজ এলাকায় পৌঁছান। তবে শুষ্ক মৌসুমে বালুর গভীরতা বেশি থাকায় ঘোড়ার গাড়িতে করে ভোগান্তি নিয়ে মালামাল পরিবহন করতে হয়।
চরাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও কৃষকরাও অনুরূপভাবে বিভিন্ন প্রকার মালামাল ও কৃষি পণ্য ক্রয় করে ঘোড়ার গাড়িতে চরাঞ্চলে নিয়ে আসেন। ঘোড়ার গাড়ি চালকরা দূরত্ব অনুযায়ী প্রতি মণ মালামাল ও কৃষি পণ্যের ভাড়া নেন।
ঘোড়ার গাড়ির চালক আয়নাল (১২) জানান, সে তার বাবার সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি চালায়। আজ তার বাবা অসুস্থ থাকায় সে একাই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। চরাঞ্চলে মালামাল পরিবহনের জন্য অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করা সম্ভব নয়। যেহেতু বালুর পরিমাণ অনেক বেশি, তাই ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল পরিবহন করে তারা। এতে সারাদিনে ৬০০-৮০০ টাকা আয় হয়।
অপর এক চালক জলিল মিয়া (৫০) জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চর যাত্রাপুর এলাকায় ঘোড়ার গাড়ি চালান তিনি। সপ্তাহে দুটি হাট বসে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপুরহাটে। সেই হাটে প্রায় চল্লিশটিরও অধিক চরের মানুষ আসেন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ কৃষি পণ্য কিনতে। একটি হাটে সারা দিনে তার আয় হয় ৫০০-১০০০ টাকা। তবে বালুর গভীরতা বেশি হওয়ায় পরিশ্রম বেশি হয় বলে জানান তিনি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, কুড়িগ্রামের প্রায় ৩০-৪০টি চরের মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দেয়। তবে যাত্রাপুর ঘাট পর্যন্ত মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি। এসব চরাঞ্চলের শত শত মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
নদী বন্দর / বিএফ