দখল ও দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে কুষ্টিয়ার আটটি নদী। জেলার ছয়টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদী এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে। এসব নদীর বেশিরভাগই পদ্মা-গড়াইয়ের শাখা হলেও অবৈধ দখল, পলি জমে যাওয়া ও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ভরা যৌবন হারিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রশাসনের নজরদারির অভাবে অনেক স্থানে প্রভাবশারীরা নদীর বুকে পিলার দিয়ে বিভিন্ন পাকা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। জলাধার সংরক্ষণ আইন থাকলেও কেউ এর তোয়াক্কা করছেন না। নদ-নদী ও খাল-বিল দখল করে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে।
সরকারি এক হিসাব বলছে, কুষ্টিয়ায় নদ-নদী ও খাল-বিল দখলকারীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আবার নদ-নদী দখলের পাশাপাশি সমানতালে চলছে নদী দূষণের পাল্লা। কল-কারাখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে। কোথাও কোথাও ড্রেনের সংযোগ এমনকি মলমূত্রও গিয়ে মিশছে এসব নদীতে।
দৌলতপুর থেকে শুরু করে খোকসা উপজেলার মাঝপাড়া পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত পদ্মা নদী। এর প্রধান শাখা গড়াই নদী ৫০ কিলোমিটার, গড়াই নদীর শাখা কালী নদী ছেঁউড়িয়া থেকে ৩৫ কিলোমিটার, সাগরখালী নদী ভেড়ামারা থেকে ১৫ কিলোমিটার এবং হিসনা নদী ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এক যুগ আগেও জেলার এসব নদ-নদীগুলোর যৌবন ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দখল এবং দূষণের কারণে নদীগুলো এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি নদীর এখন পানি প্রবাহ নেই।
দৌলতপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা থেকে উৎপন্ন মাথাভাঙ্গা ও হিসনা নদী। কিন্তু দখল ও দূষণের কারণে নদী দুটি এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে। নদীর বেশিরভাগ জায়গাই এখন দখলদারদের কবলে। বর্ষা মৌসুমে নদী দুটির কোথাও কোথাও পানি দেখা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে একেবারে মরা খালে পরিণত হয়। কোথাও কোথাও নদীর বুকে তামাক ও ধানচাষ করা হচ্ছে।
ভেড়ামারা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে চন্দনা নদী। পদ্মা থেকে উৎপন্ন হওয়া এক সময়কার চন্দনা নদীর কোনো অস্তিত্ব এখন আর চোখে পড়ে না। প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে নদীর বেশিরভাগ।
মিরপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সাগরখালী নদী। নদীটি এখন মৃতপ্রায়। কয়েক বছর আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে খনন করে নদীটি আবার সচল করার উদ্যোগ নিলেও তাতে কোনো সুফল মেলেনি। নদীর দীর্ঘ এলাকা এখন পানিশূন্য।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদ। গড়াইয়ের শাখা এ নদটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। বাঁধ দিয়ে মাছচাষ করা হচ্ছে নদটিতে। ঝাউদিয়া ও বৈদ্যনাথপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় নদীর বড় অংশ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে।
কুমারখালীর ডাকুয়া ও কালী নদী শুকিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। খোকসা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সিরাজপুর হাওর নদী। গড়াইয়ের অন্যতম এ শাখা নদীটি শুকিয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। নদীর দুই অংশে দুটি কালভার্ট ও স্লুইস গেটে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে নদী তার স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার নদ-নদী ও খালের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত তিন হাজার দখলদার রয়েছে। ফলে নদ-নদী ও খালের প্রবাহ এখন আর স্বাভাবিক নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন পৃথকভাবে এসব দখলদারদের চিহ্নিত করেছে।
জেলার ছয়টি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করে এ তালিকা তৈরি করেছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কার্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, কয়েক বছর আগের করা এ তালিকার বাইরে বর্তমানে দখলদারদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া দখলদারদের তালিকায় রয়েছে পদ্মা নদী, গড়াই নদী ও কয়েকটি বিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় এসব নদ-নদীর বাইরেও দখলে রয়েছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের ছোট-বড় খালগুলো। তবে সবচেয়ে বেশি দখলদার রয়েছে ভেড়ামারার হিসনা নদীতে। সেখানে নদী দখল করে পাকা দালানও করা হয়েছে।
সরেজমিন হিসনা নদী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর উভয় পাড়ে বাড়ি ও দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর বুকে পানি না থাকায় কোনো কোনো জায়গায় ধানচাষ করা হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা একটা নদী।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক সময় হিসনা নদীতে বড় বড় ট্রলার চলতো। তবে নদীর বর্তমান অবস্থা দেখে সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী, পদ্মা নদী, গড়াই নদী ও সেচ প্রকল্পের ছোট-বড় খাল দখল করে আছে অন্তত দুই হাজার ৯২১ জন দখলদার। বেশিরভাগই পাকা ও আধাপাকা টিনের বসতঘর। কোনো কোনো জায়গায় টিনের দোকান রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে দখল করে বাস ও ব্যবসা করে আসছেন তারা।
জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম বলেন, নদ-নদী ও খাল দখলকারীদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। যেকোনো উপায়ে নদ-নদী ও খালের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন জানান, করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে জেলায় উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে। তবে খুব শিগগিরই এসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশকর্মী খলিলুর রহমান মজু বলেন, তিনি প্রতিদিন সকালে গড়াই ও পদ্মা নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে বের হন। কিন্তু নদীর দিকে তাকালে দখল ও দূষণ দেখে কষ্ট লাগে। তিনি বলেন, দখলদারদের যখন চিহ্নিত করা গেছে তখন তাদের আইনের আওতায় আনতে বাধা কোথাই?
নদী বন্দর / জিকে