ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের পর ধান চাষে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায় আশঙ্কাজনভাবে। সর্বপ্রথম ১৯৫৬ সালে ফসলের পোকামাকড় দমনে ৩ টন কীটনাশক আমদানি করা হয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে কীটনাশকের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৭৫৬৩ মেট্রিক টন (সূত্র: বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন এসোসিয়েশন)। ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণে আউশ মৌসুমে ২৪%, আমনে ১৮% এবং বোরোতে ১৩% ধানের ফলন কমে যায়।
ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে ধান ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকরা নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতি মৌসুমে কৃষকরা মাজরা পোকা, পাতামোড়ানো পোকা, পামরি পোকা, বাদামি ঘাসফড়িং ও গান্ধিপোকা দমনের জন্য গড়ে তিন থেকে চারবার ধানের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। কীটনাশক প্রয়োগে একদিকে যেমন মাটি, পানি ও বায়ু বিষাক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধিও পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগে মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। মুখে মাস্ক, গায়ে এপ্রোন, চোখে চশমা ও হাতে দস্তানা পরে কীটনাশক প্রয়োগ করার নিয়ম। কৃষকরা মাঠ পর্যায়ে খালি গায়েই কীটনাশক স্প্রে করছেন। এতে করে কৃষকরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। ত্বকের ক্ষত, জ্বালাপোড়া, ক্যানসার ইত্যাদি হতে পারে। কীটনাশক নাক ও মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে কিডনি ড্যামেশ করে দিতে পারে।
তাছাড়া শরীরে অন্যান্য জটিল রোগ তৈরি করতে পারে। কীটনাশক কৃষকদের অন্ধত্বেরও কারণ। কীটনাশক দীর্ঘমেয়াদি মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে ব্রির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কীটতত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির বলেন, খালি গায়ে কীটনাশক স্প্রে করা উচিত নয়, এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। কীটনাশক স্প্রে করার সময় কৃষকরা শরীরে পুরাতন কাপড় পরিধান, নাক-মুখ পুরাতন গামছা পেছিয়ে নিতে পারেন, চোখে চশমা ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমে।
বিনা খরচেই পার্চিং করা যায়। স্বল্প খরচে হাতজাল তৈরি করা যায়। কীটনাশকের বিষক্রিয়া থেকে পরিবেশ বিশেষত পানি ও বায়ু দূষণমুক্ত থাকে। কৃষক নিজেই হাতজাল ব্যবহার করে আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়েই ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপস্থিতি সনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারবে।
জমিতে বন্ধু পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যেগুলো পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের ডিম ও লার্ভা খেয়ে দমন করবে। কীটনাশকের ব্যবহার ৫০-১০০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা যাবে। বিঘা প্রতি ধান উৎপাদন খরচ ১০০০-১৫০০ টাকা সাশ্রয় হবে। কীটনাশকের ব্যবহার কমলে কৃষক ও ভোক্তা দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া থেকে বাঁচবে।
বরিশালের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মূলত দুইটি খামার নিয়ে গঠিত। এগুলো হচ্ছে,- চরবদনা খামার ৭৫ একর, সাগরদী খামার ২০ একর। ২০১৯ সালের বোরো মৌসুমে দুই খামারেই মাজরা পোকার প্রচণ্ড আক্রমণ দেখা দেয়।
তিনবার কীটনাশক স্প্রে করেও পোকা দমন করা যাচ্ছিল না। এরপর কীটত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির, মাজরা পোকায় খাওয়া সাদা শীষ (মাজরা পোকায় নষ্ট করা) সংগ্রহ করে গাছের কাণ্ডের ভেতর কালো মাথার মাজরা পোকার উপস্থিতি দেখতে পান। তারপর কারটাপ গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করে মাজরা পোকা দমন করেন।
একই বছরের আমন মৌসুমের ব্রি বরিশালের সকল ধানের জমিতে চারা রোপণ থেকে গাছে ফুল আসার আগ পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মাজরা পোকা ধরে মেড়ে ফেলা হয়। একই সঙ্গে হাতজালে কোনো উপকারী পোকা আসলে সেটি পুনরায় ধানের জমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য ক্ষতিকর পোকার সিংহভাগই বাদামি রঙের আর উপকারী পোকাগুলো রঙিন হয়ে থাকে। হাতজাল দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাজরা পোকা ধরার সময় ধান গাছের পাতা হতে ডিমের গাদা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হত।
এক্ষেত্রে চরবদনা খামারে দুই জন ও সাগরদী খামারে একজনকে হাতেকলমে প্রশিক্ষিত করেন এ কীটত্ত্ববিদ। এ পদ্ধতিতে ২০১৯ সালের আমন, ২০২০ সালের আউশ, আমন ও বোরো এবং ২০২১ সালের আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে কোনো প্রকার কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই ধান উৎপাদিত হয়েছে।
ব্রি বরিশালের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, ধানের জমিতে ২৬৬ প্রজাতির ক্ষতিকর পোকা ও ৩৪৬ প্রজাতির উপকারী পোকা রয়েছে। ধানের চারা লাগানেরার শুরুতেই কীটনাশক প্রয়োগ করলে উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় পোকাই মারা যায়। পরবর্তীতে ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায় না।
তাই চারা রোপণের পর থেকে ফুল আসা পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মাজরা পোকা ও তার ডিম সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেললে কীটনাশক প্রয়োগ করার দরকার পড়ে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাজরা পোকা গাছের পাতায় বসে থাকে। তখন হাতজাল দিয়ে হেঁটে হেঁটে পোকটি সহজেই ধরা যায়। একই সঙ্গে ধানের জমিতে চারা রোপণের পরপরই ডালপালা পুঁতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা (পার্চিং) করতে হবে।
ব্রি বরিশালে প্রযুক্তিটি সফল হবার পর কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার উওর রাওঘা গ্রামের রাওঘা ব্লকে ১০ একর জমিতে আমন মৌসুমের ধানের প্রদর্শনীটি দেওয়া হয়। প্রদর্শনীতে কৃষকদের ব্রি ধান৭৬ এর বীজ দেওয়ার পাশাপাশি হাতজালও বিতরণ করা হয়। প্রদর্শনীতে কৃষকদের হাতজাল দিয়ে ক্ষতিকর পোকা ধরে ধ্বংস করা ও উপকারী পোকা (রঙিন পোকা) আবার জমিতে ছেড়ে দেবার পদ্ধতি হাতে কলমে শিখিয়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি উক্ত প্রদর্শনীটির মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দেড় শতাধিক কৃষক বিষমুক্ত ধান চাষের মাঠ দিবসে উপস্থিত হন। ব্রির কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শেখ শামিউল হক বলেন, চারা রোপণের পর মাজরা পোকা কিছু গাছের কাণ্ড কেটে দিলেও ফলনের কোনো ক্ষতি হয় না।
কারণ হিসেবে তিনি জানান, পরবর্তীতে যে কুশিগুলো জন্মে সেগুলো হতে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষকরা ১ থেকে ২টি পোকা দেখলেই কীটনাশক প্রয়োগ শুরু করেন। ধানের জমি চারা রোপণের প্রথম ৩০ থেকে ৪০ দিন কীটনাশকমুক্ত রাখতে হবে। আজকে আপনারা কীটনাশকমুক্ত যে ধান চাষ করলেন তা আশাব্যাঞ্জক।
প্রদর্শনীর একজন কৃষক মো. আজাদ জানান, বিষমুক্ত এ প্রদর্শনীতে তিনি প্রতি তিন শতকে ২ মণ ধান পাবেন।কীটনাশকের জন্য কোনো বাড়তি খরচ করতে হয়নি বলেও জানান।
প্রদর্শনীর একজন কৃষক হানিফ মাস্টার জানান, তিনি হাতজাল দিয়ে ধানের জমি থেকে পোকা ধরেছেন। কোনো প্রকার কীটনাশক ব্যাবহার করেননি। এ কৃষকের জমিতে কীটনাশকমুক্ত ব্রি ধান ৭৬ চাষ করে ৪.৫ টন প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া গেছে।
বিষমুক্ত ধান চাষের এ প্রযুক্তিটি সম্পর্কে ব্রি বরিশালের প্রধান ও মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর হোসেন জানান, পর্যায়ক্রমে এ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভাগের ছয় জেলার কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। বিষমুক্ত ধান চাষের এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে একদিকে কৃষকরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবেন, তেমনি কৃষক ও নাগরিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে যাবে।
নদী বন্দর / পিকে