পাবনার চাষিরা পেঁয়াজ চাষে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। কন্দ বা মূলকাটা পেঁয়াজ চাষ করে কম লাভবান হওয়ায় তারা হালি বা চারা পেঁয়াজ নিয়ে এখন সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন। এবার জ্বালানি তেল ও সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। তারপরও পেঁয়াজ আবাদ চলছে উৎসবমুখর পরিবেশে। কৃষি শ্রমিকরা সূর্যোদয়ের আগেই মাঠে হাজির হচ্ছেন। সাত সকালেই শ্রমিকদের পদচারণায় মুখর গ্রামের সড়ক কিংবা মেঠোপথ।
সারাদিন কাজ শেষে কৃষকরা বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যার আগে। কৃষি শ্রমিকরা ভালো মজুরিও পাচ্ছেন। চাষিরা বলছেন পেঁয়াজ আমদানি না হলে তারা লাভের মুখ দেখবেন। তা না হলে ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে তাদের আশঙ্কা।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫-২৬ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। আর পাবনা জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন। সে হিসেবে সারাদেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দুটি উপজেলায়।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জেলার চাষিরা দুটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ করেন। এর একটি কন্দ (মূলকাটা বা মুড়ি) ও অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ও হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। মূলকাটা পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ ডিসেম্বর মাসে হাটে উঠতে শুরু করে। আর হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ হাটে ওঠে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, পাবনা জেলায় এবার ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে হালি (চারা) পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি জানান, এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন। তিনি জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার পাবনা থেকে অন্তত সাত লাখ ৪৯ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হবে।
তিনি আরো জানান, গত বছর (কন্দ ও চারা পেঁয়াজ মিলিয়ে) ৫২ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯৯৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সাঁথিয়া উপজেলাতে ১৭ হাজার ১৫০ হেক্টর আর সুজানগর উপজেলায় ২০ হাজার ৬৪১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পাবনা জেলার এ দুটি উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়।
২০২০ সালে পাবনা জেলায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমিতে বেশি অর্থাৎ প্রায় ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছিল। আগের দুবছর পেঁয়াজের ভালো দাম পেয়েছেন চাষিরা। এবছর মৌসুমের শেষের দিকে চাষিরা হালি পেঁয়াজের ভালো দাম পেয়েছেন। এজন্য কৃষকেরা এবার পেঁয়াজ চাষে আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। এ বছরও পাবনায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি বিশেজ্ঞরা আশা করছেন।
রোববার (৯ জানুয়ারি) পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলার বিল গ্যারকাপাড়, বিল গাজনা পাড়, কুমিরগাড়ী, বামনডাঙ্গা, বামনদি ও ইসলামপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায় পেঁয়াজ চাষের ব্যস্ততা। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ পেঁয়াজের মাঠে। বাড়ির নারীরাও পুরুষ সদস্যদের কাজে সহায়তা করছেন। পেঁয়াজ চাষিরা জানান, এ সময় কৃষি শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে।
সূর্য ওঠার আগেই মাঠে হাজির হওয়া শ্রমিকরা জানান, তারা প্রতিদিন পেঁয়াজ লাগিয়ে ৭০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। পাশের গ্রাম আবার কেউবা দূরের গ্রাম থেকে পেঁয়াজ লাগাতে আসছেন। শ্রমিকরা ভালো মজুরি পেলেও চাষিদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন।
শনিবার (৮ জানুয়ারি) দেশের অন্যতম বড় পেঁয়াজের হাট সাঁথিয়ার বনগ্রাম হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মণ কন্দ পিঁয়াজ সাড়ে ৮০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে খুবই ভালোমানের কিছু পেঁয়াজ ১২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। চাষিরা জানান, গত বছর এ সময়ে কন্দ পেঁয়াজের দাম ছিল ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা মণ।
হাটে পেঁয়াজের আড়তদার ইব্রাহিম হোসেন বলেন, মাস চারেক আগে প্রতি মণ বীজ পেঁয়াজের দাম ছিল তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা। বেশি দরে পেঁয়াজ কিনে চাষিরা কন্দ পেঁয়াজর আবাদ করেছিলেন। তবে সে অনুযায়ী দাম বেশি হয়নি। ফলে চাষিদের লাভ হয়েছেন কম। এখন পেঁয়াজ বাজারে অনেকটা মন্দা হাওয়া লেগেছে।
তিনি আরও বলেন, তিন মাসের মধ্যে নতুন হালি পেঁয়াজ হাটে উঠতে শুরু করবে। তখন আরও দাম কমার আশঙ্কা রয়েছে। পেঁয়াজের দাম এভাবে নেমে গেলে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন আর লাভবান হবেন মধ্যসত্ত্বভোগীরা।
সাঁথিয়া উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের চাষি আফতাব উদ্দিন, কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আরশেদ খাঁন, কানু খাঁন এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হলে শুরুতেই পেঁয়াজ বীজ কেনা, চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা ভাড়া করতে হয়। জমি চাষ সেচ, সার, গোবর, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলন খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়।
এর পাশাপাশি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন তাদের বিঘা প্রতি বছরে ১০ হাজার টাকা লিজমানি জমির মালিককে দিতে হয়। এজন্য তাদের খরচ হয় আরো বেশি। এছাড়া অনেক ছোট-বড় চাষি চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পিঁয়াজ চাষ করেন।
পেঁয়াজ চাষের প্রধান এলাকা সাঁথিয়ার বিল গ্যারকা পাড়ের চাষি ইয়াজ উদ্দিন খাঁন জানান, পেঁয়াজের দাম বাড়লে জমির বার্ষিক লিজ মানিও বাড়ে। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যারকা বিল পাড়ের জমিতে বছর হিসেবে লিজমানি এ বছর প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এর সাথে রয়েছে উৎপাদন খরচ বিঘা প্রতি ৩০ হাজার টাকা।
তারা জানান, এক বিঘায় পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৪০-৫০ মণ। সে হিসেবে ৬০০ বা ৭০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলে চাষির উৎপাদন খরচ ওঠে না। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ কেউ হিসেব করেন না, হিসেব করেন শুধু কত টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে!
তারা বলেন, বছরের পর বছর ধরে পেঁয়াজের দাম কম থাকবে, এ ধারণাটা চাষিদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। তারা বলেন, দেশে সব কিছুর দাম বাড়ছে, জনগণের আয় বাড়ছে। তাই মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজের দামও প্রতিবছর বাড়লেই কেবল চাষিরা লাভবান হতে পারবেন।
সাঁথিয়ার পদ্মবিলা গ্রামের চাষি রতন আলী বলেন, তারা অন্যের জমি বছর হিসেবে লিজ নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজ চাষ করে কোনো বছর লাভ আবার কোনো বছর ক্ষতি হয়। তিনি জানান, ক্ষতি হলে বছরে অন্য দুটি ফসল চাষ করে তারা সে ক্ষতি পূরেণের চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ ফার্মার্স এসোসিয়েশন (বিএফএ) এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পাবনা জেলার বিশিষ্ট চাষি আলহাজ্ব শাহজাহান আলী বাদশা জানান, দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে, পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়েছে। তাই বিঘা প্রতি ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য অন্যান্য ফসলের মতো পেঁয়াজের উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাত সম্প্রসারণ করা দরকার।
দোতলা কৃষির উদ্ভাবক, পাবনার কৃষিবিদ জাফর সাদেক জানান, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে সে দাম সাধারণ চাষিরা পান না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয়। বাধাইকারকরা বেশি দাম ধরতে পারে। তিনি জানান, পেঁয়াজ চাষে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার সরকারি ঘোষণা থাকলেও সাধারণ চাষিরা সে সুবিধা পাচ্ছেন না। অনেকেই চড়া সুদে মহাজনী ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও বাড়ছে। উন্নত জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে। তবে সেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। চাষি পর্যায়ে পৌঁছাতে সঙ্গত কারণেই সময় লেগে যায়। তারপরও বেশ কিছু উচ্চ ফলনশীল জাত চাষির কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি জানান, চাষিরা নায্য দাম পাবেন বলে তারা আশাবাদী।
নদী বন্দর / এমকে