সিলেটে বন্যাদুর্গত মানুষ খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। কর্মহীন হয়ে পড়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেশির ভাগ মানুষই সরকারি ত্রাণের অপেক্ষায়। সে তুলনায় ত্রাণের সরবরাহ কম।
গতকাল শনিবার সকালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ জেলার কোম্পানীগঞ্জে আনুষ্ঠানিক ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করলে মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। অনেকে ত্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ত্রাণ না পেয়ে দুর্গত মানুষ হতাশা প্রকাশ করে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুুর পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জিয়াদ আলী বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বন্যার্তদের তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। এতে এক পরিবারকে দিলে আরেক পরিবারকে দেওয়া যাচ্ছে না। ত্রাণ বিতরণ করতে গেলে মানুষ জোর করে নিয়ে যেতে চায়। ’ উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ন্যূনতম পাঁচ হাজার প্যাকেট ত্রাণ দরকার যেখানে, সেখানে মন্ত্রী বিতরণ করেছেন ২০ প্যাকেট।
ত্রাণ না পেয়ে উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর লাছুখাল গ্রামের আরজু বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীও নেই, ছেলেসন্তানও নেই। ঘরের ভেতর কোমরপানি। রাস্তায় গলাপানি ভেঙে ত্রাণ নিতে এসেও পাইনি। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইছাকলস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান সাজু বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবার। বৃহস্পতিবার পেয়েছিলাম দুই টন চাল। ১০ কেজি করে এ ত্রাণ ২০০ পরিবারকে দেওয়া যাবে। এখন নারী সদস্যসহ ৯ ইউনিয়নে ১২ জন ইউনিয়ন সদস্য। তাঁরা একেকজন গড়ে ১৫ জনকে দিতে পারবেন। একটি ওয়ার্ডে আছে ৫০০ পরিবার আর ত্রাণ দেওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৫ পরিবারকে। ’
জেলার বন্যা আক্রান্ত উপজেলাগুলোর প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার ১১ উপজেলায় বন্যায় সাত লাখ ৮৫ হাজার ৮২৫ মানুষ পানিবন্দি। এর মধ্যে দুই লাখ ৪০ হাজার জন সিলেট সদর উপজেলায়। এ ছাড়া জকিগঞ্জে এক লাখ ৮০ হাজার, কানাইঘাটে ৬৫ হাজার, বিয়ানীবাজারে ৬৯ হাজার ৮৭৫, জৈন্তাপুরে ৫০ হাজার, কোম্পানীগঞ্জে ৪৬ হাজার ৫০০, গোয়াইনঘাটে ৪৫ হাজার, বিশ্বনাথে ৪০ হাজার এবং গোলাপগঞ্জে ৪৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি। দক্ষিণ সুরমায় তিন হাজার ৪৫০ ও ফেঞ্চুগঞ্জে এক হাজার মানুষ পানিবন্দি।
জানা গেছে, গতকাল সকাল ১০টায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের থানা বাজার পয়েন্টে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী ইমরান আহমদ। মন্ত্রী নিজে কয়েকজনের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সময় তালিকাভুক্ত ১২০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু ত্রাণ নিতে আসা মানুষ নানাভাবে আকুতি জানাতে থাকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে। এক পর্যায়ে ত্রাণপ্রত্যাশীরা হট্টগোল শুরু করে। ত্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় প্রশাসন বাধা দিলে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা সুমন আহমদ বলেন, হঠাৎ শতাধিক মানুষ ত্রাণের বস্তা নিয়ে টানাটানি শুরু করে। এ সময় পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন তাদের লাঠিপেটা করে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সুকান্ত চক্রবর্তী বলেন, ত্রাণের তুলনায় বেশি লোক উপস্থিত হয়েছিল। পরে যারা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে যারা ত্রাণ পায়নি তাদের ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি হয়। পুলিশ কাউকে আঘাত করেনি। শুধু দুই পক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ রকম হওয়ার কথা নয়। কেন ঘটল তা আমি খবর নিয়ে দেখছি। পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ আছে। ’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, এখানে ২০০ জন লোক ছিল। ত্রাণ নিতে গিয়ে তাড়াহুড়া করায় কিছুটা বিশৃঙ্খলতা হয়েছে। তবে মারামারি হয়নি।
একই অবস্থা অন্য উপজেলাগুলোতেও। বন্যাকবলিতদের তুলনায় ত্রাণের পরিমাণ কম বলে দাবি করছেন জনপ্রতিনিধিরা। জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিনমজুর কামাল আহমদ বলেন, ‘বন্যায় জরাজীর্ণ ঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চতুর্দিকে পানি থাকায় কাজও পাচ্ছি না। ঘরের চার সদস্যকে নিয়ে বিপাকে পড়েছি। এখন পর্যন্ত ত্রাণ পাইনি। ’
এসব বিষয়ে কথা বলতে জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।
ত্রাণস্বল্পতার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ার সাদাত বলেন, ‘বন্যাকবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত ৩০৫ মেট্রিক টন চাল, ১৫ লাখ টাকা ও চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠিয়েছি। সেগুলো বিতরণও করা হচ্ছে। ’ চাহিদার তুলনায় অনেক কম ত্রাণ আসছে বলে জনপ্রতিনিধিদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ত্রাণ আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেগুলো বন্যাদুর্গত এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। পাশাপাশি আরো ত্রাণ চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ’
বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে
জেলার পাঁচটি পয়েন্টে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রাবাহিত হলেও আগের দিনের তুলনায় পানির উচ্চতা কিছুটা কমেছে। এতে সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। তবে সিলেট সদর উপজেলা, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও বিশ্বনাথে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত।
সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি কমছে
সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি কমলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরে আরো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা এবং ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বন্যার্তরা। তবে অনেক হতদরিদ্র মানুষ নিমজ্জিত বাড়িঘর ছেড়ে আসতে চাচ্ছে না। তারা বাড়িতে অবস্থান করলেও বিদ্যুত্হীন অবস্থায় আছে। ডুবে গেছে তাদের শৌচাগার ও নলকূপ। জেলার পাঁচটি উপজেলার লাখো মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত বলেন, ‘আমরা পৌর শহরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করছি। সেই তালিকা ধরে গরিব ও অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার প্রস্তুতি নিয়েছি। এ ছাড়া যারা আশ্রয়কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নিয়েছে তাদের আমরা খাদ্য সহায়তা দিচ্ছি। ’
নদী বন্দর/এসএফ