কক্সবাজারের সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে নিম্নাঞ্চল ভরাট করছে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার। এতে শাহপরীর দ্বীপ রক্ষায় প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধটি ঝুঁকিতে পড়েছে।
কারণ নতুন এ বাঁধের ওপর দিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার ড্রেজিং পাইপ বসানো হয়েছে। সেন্টমার্টিন রুটে জেগে উঠা ডুবোচর অপসারণের মাধ্যমে এই পার্ক ভরাট করার সুপারিশ ছিল পাউবোর। কিন্তু সেটি উপেক্ষা করে নাফ নদী থেকে বালু তোলা শুরু হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ভরাটের নামে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাফ নদী থেকে বালু তুলে বাইরে বিক্রি করার নজিরবিহীন অভিযোগ পেয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এ ঘটনায় শনিবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এরফানুল হক চৌধুরী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবারকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেন।
অবৈধভাবে হারিয়াখালী-শাহপরীর দ্বীপ সড়ক নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেকে এন্টারপ্রাইজের কাছে বালি বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে চায়না হারবারের বিরুদ্ধে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ফয়সাল ডিউককে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৩ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর শনিবার রাতেই অর্থদণ্ড আদায় করে সতর্ক করা হয়। এদিকে ১৮ ডিসেম্বর বালু উত্তোলন বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বেড়িবাঁধের ওপর মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভাও করেন শাহপরীর দ্বীপের মানুষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) আব্দুল আজীম চৌধুরী বলেন, চায়না হারবার বাইরে নাফ নদীর বালু বিক্রি করছে তা আমি জানি না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ড্রেজিং পাইপ বসানো নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন থাকার কথা নয়।
তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বালি বিক্রির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘চায়না হারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বালু বিক্রির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে অর্থদণ্ড আদায় করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বেজা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে নিম্নাঞ্চল বালি ভরাটের বিষয় নিয়ে সমস্যা ছিল। জেলা প্রশাসক হিসাবে আমি সমাধান করে দিয়েছি।’
নথিপত্র থেকে জানা গেছে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর পাউবোর কক্সবাজারের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে মাটি ভরাটে চায়না হারবারকে বাধা দেয়।
এতেও বালু তোলা বন্ধ না হওয়ায় পাউবোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়টি লিখিতভাবে জানান তিনি। কাজের মান বজায় রাখতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা বাঁধ এবং সংশ্লিষ্ট গ্রামের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে ড্রেজিং পাইপ বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে বাঁধের উপর দিয়েই পাইপ লাইন স্থাপন করতে থাকে। বরং এই পাইপ বসাতে পাউবো কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করতে থাকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
শেষ পর্যন্ত কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব, বেজা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি এবং পাউবোর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সাইট পরিদর্শন করা হয়।
পরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব রোকন উদ-দৌলা ও বেজার নির্বাহী সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) আব্দুল আজীম চৌধুরী সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শনও করেন।
দুই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকের মধ্যেই নতুন বাঁধের ওপর দিয়েই প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার ড্রেজিং পাইপ বসায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার।
এ বিষয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর দাপ্তরিক চিঠির একস্থানে বলা হয়, বেজা কর্তৃপক্ষ যে এলাকা থেকে ড্রেজার সরঞ্জাম সংগ্রহ করবে তা কারিগরি দিক পর্যালোচনা সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
তা-না হলে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের ভূখণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এছাড়া পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রোকন উদ-দৌলা বেজা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, সম্প্রতি নাফ নদীর মোহনায় চর জেগে উঠেছে।
এই চরের কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডুবোচর অপসারণে একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের জন্য নির্ধারিত নিম্নাঞ্চল ভরাট করতে নাফ নদীর মোহনা থেকে বালি ড্রেজিং না করে ডুবোচর অপসারণের কথা বলেন তিনি।
এমনকি এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোর সঙ্গে সমন্বয় করা জরুরি বলেও জানান তিনি। অথচ শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব মতামত উপেক্ষা করেই ব্যয়বহুল বাঁধকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেই মাটি ভরাটের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করা হয়েছে।
এদিকে নির্বাহী প্রকৌশলীর লিখিত অভিযোগের এক স্থানে বলা হয়, এককভাবে পাউবোর সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ বা মতামত ছাড়াই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে মাত্র ৪শ মিটার দূর থেকে ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়। এর ফলে বেড়িবাঁধসহ বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন ভূখণ্ড নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, বাঁধের উপর শুধু পাইপ বসানোই নয়, গত পাঁচ মাস ধরে ঝুঁকিপূর্ণ নাফ নদীর মোহনা থেকে ড্রেজিং করে বালি ভরাটের প্রথম পর্যায়ের কাজও শেষ হয়েছে। বাঁধের মাত্র ৪০০ মিটার দূর থেকে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালিমাটি সংগ্রহ করায় সীমান্তসংলগ্ন ভূখণ্ড বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছে খোদ পাউবো।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাগরে নিম্নচাপের কারণে সাগরের উচ্চ ঢেউয়ের আঘাতে শাহপরীর দ্বীপ এলাকা নিশ্চিহ্ন হয় প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত ওই বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট ২৮৫ মিটার প্রতিরক্ষামূলক কাজসহ ৩০৫ মিটার সি-ডাইক পুনর্নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন হাতে নেয় পাউবো।
ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ বিবেচনায় দুই দফায় ডিপিপি সংশোধন করে ১৫১ কোটি ৮৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এরপরই ২টি প্যাকেজের মাধ্যমে মানসম্মত বাঁধ তৈরি শুরু করে পাউবো।
এ অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক প্রকল্প এলাকার নিম্নাঞ্চল ভরাট কার্যক্রম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকা থেকে বালু তুলতে শুরু করে।
এতে ওই এলাকায় ভবিষ্যৎ ভাঙন প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়ে বেজাকে মাঠপর্যায় থেকে একাধিকবার সতর্কও করা হয়। এর পরও বালি উত্তোলন অব্যাহত রাখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এখন ড্রেজিং করে বালু তুলে তা বিক্রিও করছে বিতর্কিত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
নদী বন্দর/এসএফ