বাংলাদেশে প্রতিবছরই বিস্তীর্ণ এলাকা নদীভাঙ্গনের শিকার হয়। এতে করে বছরে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙনে হারিয়ে যায় এবং অন্তত এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দাঁড়ায় বছরে ২ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা উপরে।
এদেশে বছর জুড়েই বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন থাকে। তবে মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভাঙন তীব্র হয়। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রক্ষপুত্র নদ-নদী ছাড়াও ছোট বড় অসংখ্য নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ী, ফসলের জমি, হাট-বাজার, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্থাপনা হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়।
নদী ভাঙনকবলিত এমনি একটি এলাকা হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ জেলা। পদ্মা নদীর ছোঁবলে এখানকার মানুষগুলো দিশেহারা। বর্ণ পাড়া গ্রামের চান মিয়ার বয়স ষাট পেরিয়ে সত্তরের কাছাকাছি। তার সমবয়সি দবির আকন্দ। তার বাড়ী কনক শাহ ইউনিয়নে। বাপ-দাদার ভিটাসহ দুজনেরই জমি-জমা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন তারা নিঃস্ব। তারা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘নদী ভাঙলে কপাল ভাঙ্গে।’ একসময় তাদের গোলা ভরা ফসল থাকলেও এখন তারা দিনমজুর। জীবনের শেষ সময়ে তাদের আকুতি একটাই, নদী ভাঙনের কবল থেকে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও টংগিবাড়ী উপজেলাকে রক্ষ করা। পদ্মার ভাঙনে তাদের মত আর কেউ যেন সর্বশান্ত না হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, লৌহজং ও টংগিবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পদ্মার ভাঙনে মানুষের ঘর-বাড়ী, ফসলের জমি, বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কাজ শুরু করা না গেলে চলতি বর্ষায় নদীর গতিপথ আরও পরিবর্তন হবে। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে অসংখ্য ঘর-বাড়ী, ফসলের জমি ও স্থাপনা। যার মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিনের বাড়ী ও এবং ইউনুস খান-মাহমুদা খাতুন মেমোরিয়াল চক্ষু হাসপাতালটিও রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অত্র এলাকার নদী ভাঙন রোধে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর ভাটিতে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও টংগিবাড়ী উপজেলাধীন বিভিন্ন স্থানে পদ্মা নদীর বামতীর সংরক্ষণ’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পটির আওতায় পদ্মা নদীর বামতীরে ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ১২ লাখ টাকা।
প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
পদ্মা বহুমুখী সেতুর ভাটিতে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও টংগিবাড়ী দু’টি উপজেলা। এখানে পদ্মা নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। চলতি বর্ষায় এই ভাঙন আরও তীব্র হবে। এই এলাকায় ভাঙন এতটাই তীব্র যে, পদ্মা নদীর মাঝখানে জেগে উঠা চরে নির্মিত পদ্মা রিসোর্টটি এখন নদীগর্ভে বিলীন। গত দুই বছরে রিসোর্টের পুরোটাই নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতুর কারণে অত্র এলাকায় নদী ভাঙন বেড়েছে। এই ভাঙন রোধ এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পটি গ্রহণ করে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন পদ্মা নদীর বাম তীরের ভাঙন রোধ হবে, তেমনি স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা ও দৈনন্দিন ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাবও কেটে যাবে। ২০১৭ সালে এই প্রকল্পের ডিপিপি প্রনয়ণ করা হয় এবং ২০২১ সালে একনেকে তা পাশ হয়। প্রকল্প কাজের সমাপ্তির তারিখ ধরা হয়েছে সেপ্টেম্বর ২০২৩। শিমুলিয়া থেকে দিঘীপাড়া পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার হলেও নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ হবে সবমিলিয়ে ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটার।
যেসব পয়েন্টে এই কাজ হবে তার মধ্যে রয়েছে- শিমুলিয়া, খড়িয়া, হলুদিয়া, ব্রাক্ষ্রনগাও, বেজগাঁও, গাঁওদিয়া, সামুরবাড়ী, ডহুরি, হাসাইল, চৌষাড়া, কামারখাড়া, মিতারা ও দিঘীরপাড় গ্রামে। মোট আঠারটি প্যাকেজে এই কাজ করছে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠাণ। প্রকল্পের অর্ন্তভূক্ত ১০২০ মিটার চর অপসারণ কাজের টেন্ডার আগামী শুস্ক মৌসুমে করা হবে। এ বাবদ ব্যয় ধরা আছে ১০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হবে আগামী বছর শুষ্ক মৌসুমে। তবে চলতি বর্ষায় বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হবে। পাউবো’র মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায় হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকার সহায় সম্পদ পদ্মা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে।
নদী পারের কান্না
ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার পথ পারি দিয়েই চলে আসা যায় মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টংগিপাড়া উপজেলায় পদ্মার পারে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীচু চরগুলো ডুবে গেছে। এতে করে শিমুলিয়াতে মূল পদ্মার সাথে শাখা পদ্মা মিশে গেছে। এখান থেকে পদ্মার বাম তীর ধরে যতই ভাটির দিকে যাওয়া হবে, ততই নদী ভাঙন চোখে পড়বে। মানুষ বসত-বাড়ী সরিয়ে নিচ্ছে। অনেকেই চোখের পানি মুছছে। একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় নদীভাঙ্গন কবলিত একটি গ্রামে আসার পথে দেখলাম কয়েকটি ঘরবাড়ী ভাঙনের মুখে। গাছপালা নদীতে ভেঙ্গে পড়তে দেখা গেল। একটি বাড়ী যখন নদীতে পড়ছে, সেটির মালিকরা তখনো বাড়ীটি থেকে ইটকাঠ খোলার চেষ্টা করছিলেন।
ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হওয়া অসহায় মানুষগুলোর চোখেমুখে এক অজানা শঙ্কা। কোথায় যাবে, কি করবে? কথায় আছে- ‘নদী ভাঙলে সর্বস্ব নিয়ে যায়।’ বর্ণ পাড়া গ্রামের বয়স ষাট পেরিয়ে সত্তর ছুঁইছুঁই চান মিয়া ও কনক শাহ ইউনিয়নে দবির আকন্দ একথাই জানালেন। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে চান মিয়া বলেন, এক সময় তাদের গোলা ভরা ধান ছিল। নদী ছিল তখন বাম তীর থেকে চার কিলোমিটার দূরে। তিন দফা নদী ভাঙনে এখন তারা নিঃস্ব। দিনমজুরি করে সংসার চলে। আর দবির আকন্দ জানান, পদ্মায় বিলীন হয়েছে তাদের বসত বাড়ী, আবাদী জমি। তার বাপ-দাদার ১০ বিঘার উপর ফসলী জমি ছিল। এখন কিছুই নেই। পরের জমিতে ভাড়া থাকেন। এই বয়সেও দিন মজুরি করে সংসার চালান।
তার মতে, নদী ভাঙনের কবলে পড়ে অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়ে চলে গেছে এলাকা ছেড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই। শুধু আকুতি হচ্ছে- ভাঙন রোধে প্রকল্প কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা। তাদের চাওয়া একটাই, আর কোন পরিবার যেন নদী ভাঙনের কবলে পড়ে তাদের মত নিঃস্ব হয়ে না যায়।
বাস্তবতা
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এর মধ্যেই তারা কাজ সম্পন্ন করবেন। যদিও অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করাটা বিশাল এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হবে। তাছাড়া চলতি বর্ষায় ভাঙনের ব্যাপকতা রোধ করা না গেলে নদীর গতিপথ আরও বদলে যাবে।
এতে করে প্রকল্প ব্যয় এবং কাজের সময় দুটোই বৃদ্ধি পাবার শঙ্কা বিদ্যমান। এমনিতেই নদীর গতিপথ মূল নকশার জায়গায় নেই। ২০১৭ সালে ডিপিপি প্রনয়ণের সময় যে নকশা করা হয়েছিল এবং ২০২১ সালে যে নকশা অনুযায়ি এই প্রকল্প পাশ করা হয়, পদ্মা নদীর বাম তীরের গতিপথ এখন সেই জায়গায় নেই। চলতি বর্ষায় বিভিন্ন স্থানের ভাঙন ঠেকাতে বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। কিন্ত এতে কতটা সুফল আসবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। সামুরবাড়ী গ্রামে সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিনের দোতালা বাড়ীটি পদ্মার ভাঙন থেকে রক্ষা করতে অনেক জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এরপরও চলতি বর্ষায় পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা রয়েই গেছে। সবচেয়ে বেশি ভাঙনের কবলে রয়েছে লৌহজং উপজেলার বরাকল গ্রামটি। তেউটিয়া পুরো ইউনিয়নটিই নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় এখন তা লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়ন নামে পরিচিত। এই ইউনিয়নের ঘোড়দৌড় ও বর্ণগ্রাম এলাকাতেও চলছে ব্যাপত ভাঙন। এতসব জায়গার ভাঙন কি কয়েক হাজার জিও ব্যাগ ফেলে রক্ষা করা সম্ভব। তদুপরি রয়েছে, অর্থ সঙ্কট।
ঠিকাদার তাজুল ইসলাম অকপটেই জানালেন, ৪৪৬ কোটি ১২ লাখ টাকার প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩ কোটি টাকা। বরাদ্দ না বাড়ালে ২০২৩ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করাটা কঠিণ হয়ে দাঁড়াবে।
পানি সম্পদ উপমন্ত্রী
পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, এমপি বলেছেন, গত ১৮ মে আমি এই কাজের উদ্ধোধন করেছি। মুন্সীগঞ্জ জেলার পৌহজং ও টংগিবাড়ী উপজেলাধীন বিভিন্ন স্থানে পদ্মা নদীর বামতীর সংরক্ষণ কাজের গুণগত মান ঠিক রেখে নির্দিষ্ট সময়ে যেন প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়-সেই নির্দেশনা দিয়েছি। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের মান যেন এমন হয় যে, আগামী ৫০ বছরেও এ এলাকায় যেন আর নদী ভাঙন দেখা না দেয়। তিনি বলেন, আমার পিতা পাউবো’র এই ঢাকা ডিভিশনের কর্মকর্তা ছিলেন।মুন্সিগঞ্জের মানুষের সাথে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক। নদীর ওপারেই আমার বাড়ী। আমি এই প্রকল্পের কাজ শুধু বাস্তবায়নই নয়, এর গুনগত মান এবং যাতে টেকসই হয়- সেদিকটা কঠোরভাবে মনিটরিং করবো।প্রকল্পের কাজে অর্থ সঙ্কট হবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন ধরণের সঙ্কট দেখা দেবে না। কাজ শুরু হয়েছে। ইনশাআল্লাহ শেষও হবে।
প্রকল্প কর্মকর্তাদের বক্তব্য
প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন সরকার (কেন্দ্রীয় অঞ্চল) বলেন, প্রকল্পের কাজ যথাসময়েই সম্পন্ন হবে। আশা করি, এই কাজ সম্পন্ন হলে অত্র এলাকার নদী ভাঙন রোধ হবে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা ও দৈনন্দিন ক্ষুদ্র অর্থনীতির উপর পড়া বিরূপ প্রভাব কেটে যাবে। তিনি বলেন, প্রকল্প কাজে অর্থের কোন সঙ্কট নেই। ভবিষ্যতে প্রকল্প এলাকা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে কিনা? জানতে চাইলে বলেন, প্রকল্প এলাকা বাড়ানোর বিষয়টি পাউবো’র বিবেচনাধীন রয়েছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, প্রকল্পের প্রথম বছরে অর্থ ছাড়ের পরিমান কমই থাকে। তবে দ্বিতীয় বছরে তা বেড়ে যায়। প্রকল্পের টাকা নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। বর্ষা মৌসুমে জিও ব্যাগ ফেলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মূল কাজের অতিরিক্ত। এই জিও ব্যাগ ফেলার কারণ হচ্ছে- চলতি বর্ষায় নদী ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা। ভাঙন বেশি হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আর নদীর গতিপথ পরিবর্তন হলে কাজের নকশাও পরিবর্তন হয়ে যাবে। এতে করে কাজের ক্ষতি হতে পারে এবং প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। পদ্মা নদী বাংলাবাজার এলাকায় যেয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। একারণেই ভাটির দিকে ভাঙনের মাত্রাটা একটু বেশি।
নদী বন্দর/এসএফ