অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে সিলেট জেলার ৩০ লাখ ও সুনামগঞ্জ জেলার ২০ লাখ লোক কঠিন সময় পার করছেন।
বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় সিলেট রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর বিদ্যুৎ না থাকায় বন্যার পানিতে ডুবে থাকা সুনামগঞ্জ এখনো অন্ধকারে রয়েছে। এদিকে পানি প্রবেশ করায় গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এতে সিলেটে বিদ্যুত্সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও পানি নিষ্কাশন করে উপকেন্দ্রটি চালু করা হলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে সিলেটের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। বানভাসি এলাকাগুলোতে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির উদ্ধার তত্পরতা চলছে।
সিলেট থেকে হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে সিলেট জেলার ৩০ লাখ ও সুনামগঞ্জ জেলার ২০ লাখ লোক কঠিন সময় পার করছেন। আশির ঊর্ধ্ব অনেকেই বলছেন, তারা ইতিপূর্বে এমন বন্যা দেখেননি। বন্যার পানি ক্রমেই বাড়ছে। সারা দিন অন্ধকার হয়ে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচাবাজারসহ নিত্যপণ্যের দোকানে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় মালামাল নষ্ট হচ্ছে। বিভাগীয় শহরের জিন্দাবাজারে অনেক শপিংমলে পানি ঢুকেছে।
ওসমানী হাসপাতালেও পানি ঢুকেছে। চারদিকে বন্যার্তদের আহাজারি চলছে। মসজিদে মসজিদে দোয়া চলছে। বহু মসজিদে পানি ঢুকেছে। এদিকে বন্যার্তদের উদ্ধার ও সহযোগিতায় প্রশাসনের সাথে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী কাজ করছে। বন্যাকবলিত সিলেট ও সুনামগঞ্জের ২৪টি উপজেলায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, মোমবাতি, দিয়াশলাই, টর্চ, ছাতা, লাইফ জ্যাকেট, নগদ টাকা। আর উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য দরকার নৌকা।
সিলেটের সবগুলো উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান সন্ধ্যায় বলেন, এ পর্যন্ত সিলেটের বন্যার্তদের জন্য ৬১২ টন চাল, ৪২ লাখ টাকা ও ৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তিনি জানান, অনেক এলাকায় নৌযানের অভাবে পানিবন্দি লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে।
তারা কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করেছন। তিনি জানান, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী মিলে হাজার খানেক লোককে দুর্গম এলাকা থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখন ফাঁকা নেই। বেশির ভাগই তলিয়ে গেছে। বাকিগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে নগরের বাইরের প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি চলছে। প্রবল বর্ষণ ও ঢলের চাপে সিলেটে মানবিক বিপর্যয় চলছে। অন্যদিকে শনিবার থেকে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় বন্যা বিস্তৃতি লাভ করছে। সিলেটের অনেক স্থানে সড়ক যোগাযোগ সরাসরি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া পানি উঠায় সিলেট রেলস্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখন মাইজগাঁও থেকে ট্রেন চলাচল করছে। এর আগে রানওয়েতে পানি প্রবেশ করায় শুক্রবার থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমান উঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে সিলেট নগর ও জেলার সবকয়টি উপজেলায় পানি ঢুকে পড়েছে। সিলেটে শহরের উঁচু স্থানও প্লাবিত হচ্ছে। সিলেট ওসমানী হাসপাতালের নিচ তলায় হু-হু করে পানি ঢুকতে দেখা যায় গতকাল দুপুরে। জরুরি বিভাগ, বিভিন্ন ওয়ার্ডে পানি প্রবেশ করে। অনেক রোগী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। শহরের বিভিন্ন ছড়া ও খাল দিয়ে পানি ঢুকছে। সুরমা তীরবর্তী আবাসিক এলাকা উপশহর, সোবহানীঘাট, তেররতন, শেখঘাট, নবাব রোড, কুশিঘাট, তালতলা, কাজীরবাজার, শিবগঞ্জ, খরাদিপাড়া, তপোবন আবসিক এলাকা, আখালিয়া মাড়িয়ে পানি এখন মূল শহরের জিন্দাবাজারে পৌঁছেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সঙ্গে বৃহস্পতিবার থেকে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সেখানে সম্পূর্ণভাবে মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় অনেকেই প্রবাস থেকে এবং ঢাকা-সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের বৃদ্ধ মা-বাবা ও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। বিদ্যুৎ না থাকায় পরিস্থিতি আরো বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে।
বন্যাকবলিত সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও সুনামগঞ্জ জেলায় নৌকাই এখন ভরসা। কিন্তু নৌকারও সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। বন্যার্ত মানুষদের উদ্ধার ও প্রয়োজনীয় সেবার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বন্যার শুরু থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এখন বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। শুক্রবার থেকে সেনাবাহিনী এবং শনিবার থেকে নৌবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে। নৌবাহিনীর ডুবুরিরাও এসে পৌঁছেছেন।
শুক্রবার সিলেট কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পার্শ্ববর্তী সুরমার পানি ঢুকে পড়লে সেটি ঝুঁকিতে পড়ে। পরে সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন,পানি উন্নয়ন বোর্ড, দমকল বাহিনী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে উপকেন্দ্রেটি চালু রাখেন। কিন্তু শনিবার পানি বৃদ্ধির কারণে আবার বেলা ১১টার দিকে ঐ কেন্দ্রটি নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পানি নিষ্কাশন করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে উপকেন্দ্রটি চালু করা হলে নগরীর কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। প্রকৌশলীরা জানান, অনেক স্থানে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে।
অন্যদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসছে যুবক, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরা উদ্ধারের প্রতীক্ষায় রয়েছেন। অনেক স্থানে ঘরের চালের ওপর মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে উঁচু আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন। নৌকার অভাবে অনেকে বুক সমান পানি সাঁতরে শুকনো স্থানের দিকে ছুটছেন। কিন্তু শুকনো স্থানেরও অভাব।
অনেকেই বলছেন, সিলেটে যেন মহাপ্লাবন শুরু হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিচতলা ডুবে গেছে। আশ্রয় শিবির-এমনকি নিজের দুইতলা-তিনতলা ঘরেও লাখ লাখ মানুষ খাদ্যের সংকটে রয়েছেন। সুনামগঞ্জ শহরের অনেক বাসায় বৃদ্ধরা আটকা আছেন। ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। শহরের উঁচু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, হাসপাতাল, হোটেলে বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
কিন্তু সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাব চরমে। শহরে বিশুদ্ধ পানির উৎস ডুবে আছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় পানি উঠানো যাচ্ছে না। নিচতলায় গ্যাসের চুলাও ডুবে গেছে। সুনামগঞ্জ জেলা শহর গত বৃহস্পতিবারেই ডুবে যায়। সেখানে একতলা ভবন গুলোতে কোথাও কোমর পানি ও কোথাও বুক পানি। পৌর এলাকার শতভাগ বাসাবাড়ীতে ঢলের পানি। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গির হোসেন তার বাসভবনের কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, তারা উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া বিভাগসহ জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধূরী জানান, গত ১-১৮ জুন পর্যন্ত সিলেটে ১ হাজার ৭৮ মি.মিটার এবং শনিবার সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ১৫৭ মি.মিটার বৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, এ মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে ৩১ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে শনিবার পর্যন্ত। চেরাপুঞ্জিতে শনিবার সকাল ৬ টা পর্যন্ত ১৬২ মি.মিটার বৃষ্টি হয় জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার ঘোষ জানান, তারা সুনামগঞ্জে যোগাযোগ করতে পারছেন না। সেখানকার অফিসে কোমর পানি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন,পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে কুমারগাঁও সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। আমরা এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।
কমলগঞ্জ, জুড়ী (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, অব্যাহত বৃষ্টিপাতে কমলগঞ্জে ধলাই নদীসহ সবগুলো পাহাড়ি ছড়ায় ব্যাপকহারে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে ধলাই নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। কমলগঞ্জের পাহাড়ঘেঁষা এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে সতর্কতা জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন।
জৈন্তাপুর (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, সিলেটের জৈন্তাপুরে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে এবং বানভাসি মানুষকে উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করতে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি সকাল হতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র চালুর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ, নবীগঞ্জ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বানভাসি মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে স্থানীয় স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন। আজমিরিগঞ্জ উপজেলা সদর, বদলপুর বানিয়াচঙ্গ উপজেলার দৌলতপুর ও মুরাদপুর ইউনিয়নে ৩০টি গ্রামের দুই সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। শনিবার সকালে আজমিরিগঞ্জ-পাহাড়পুর সড়কের কৈয়ারঢালা স্লুইসগেট সংলগ্ন রাস্তা ও পাহাড়পুর-মার্কুলী সড়কের নিকলীরঢালা এলাকার রাস্তা বানের পানিতে ভেঙে গেছে।
নদী বন্দর/এসএফ