দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৯ জেলায় বন্যায় প্রায় ৭২ লাখ মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ ও শেরপুর। ওই ৯টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা। মানবিক সহায়তা দেওয়া দেশ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি যৌথ মিশনের বন্যাদুর্গত এলাকা সফরের পর গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় জাতিসংঘ, ব্রিটিশ হাইকমিশন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এ তথ্য জানায়।
এই মিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, বন্যাদুর্গত অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন আছে। ওই এলাকাগুলোতে এখনো সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি মানবিক সহায়তা হিসেবে ১৫ লাখ লোকের জন্য জাতিসংঘ পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৫৪৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা) তহবিলের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গিন লুইস, ব্রিটিশ হাইকমিশনের উন্নয়নবিষয়ক পরিচালক ম্যাট কনেল এবং ইউরোপীয় মানবিক সহায়তা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ইজাবেল ডি’হওট গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানান।
চলমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ সরকারের চলমান প্রচেষ্টায় সহায়তা হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবিক সহায়তা দেওয়া এনজিওগুলোর জন্য ১২ লাখ ইউরো (১১ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি) এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে দুই লাখ ইউরো (এক কোটি ৯০ লাখ টাকার বেশি) বরাদ্দ করেছে। ব্রিটিশ সরকার ছয় কোটি ৩৬ লাখ ৫৪৮ পাউন্ড (সাত কোটি টাকার বেশি) দিয়েছে। সুইডেন ১৩ লাখ সুইডিশ ক্রোনার (১২ কোটি টাকার বেশি) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে জরুরি অর্থায়নে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার (দুই কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি) বরাদ্দ করেছে।
উল্লেখ্য, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলো গত মে মাসে প্রথম দফা বন্যার শিকার হয়। এরপর সেই জেলাগুলোতে গত ১৫ জুন শুরু হয় দ্বিতীয় দফা বন্যা। গত ২ ও ৩ জুলাই জাতিসংঘের যৌথ মিশন বন্যার পরিধির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিক্রিয়া, সরকারের সাড়াদান পর্যালোচনা করে। জাতিসংঘ মিশন মনে করে, সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বড় পরিসরে সমন্বিত সাড়াদান কার্যক্রম চলছে।
সরকার চার লাখ ৭২ হাজার লোককে প্রায় এক হাজার ৬০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সহায়তা পেয়েছে। জাতিসংঘ ও এনজিও অংশীদাররা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা, পানীয় জল, নগদ অর্থ, জরুরি ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, মর্যাদা ও স্বাস্থ্যবিধি সরঞ্জাম এবং শিক্ষা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে।
জাতিসংঘ জানায়, তাদের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ শিশুদের সুরক্ষা, নিরাপদ পানি, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার জন্য মাঠে রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ইউনিসেফ তার অভ্যন্তরীণ তহবিল থেকে ২৮ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ১০ লাখ মানুষকে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা দিয়েছে ইউনিসেফ।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) তিন জেলার ৩৪ হাজার পরিবারকে ৮৫ টন ‘ফর্টিফায়েড বিস্কুট’ বিতরণ করেছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) গর্ভবতী মহিলাদের হাসপাতালে যেতে ও সার্বক্ষণিক সহায়তা দিচ্ছে। এই সংখ্যা প্রসবের জন্য অপেক্ষমাণ নারীদের জন্য ‘ম্যাটার্নিটি ওয়েটিং হোমও’ পরিচালনা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আড়াই লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করেছে।
জাতিসংঘ জানায়, প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দুর্গম অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন। স্থানীয় সম্প্রদায়ের অনেক প্রবীণ এই বন্যাকে তাঁদের জীবদ্দশায় দেখেছেন এমন যেকোনো বন্যার চেয়ে খারাপ বলে বর্ণনা করেছেন। বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছেছে, তাদের অনেকেই অভিযোগ করেছে যে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে নৌকার মালিকরা অতিরিক্ত টাকা নিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে তাদের সঞ্চয়ের ওপর।
নদী বন্দর/এসএফ