‘ভরাট কপোতাক্ষ নদের চরে জমি লিজ নিয়ে ৩০ বছর ধরে বাড়ি করে বসবাস করছিলাম, নদ খননে সেই বাড়ি গেছে, জমি গেছে ৬৬ শতক। তার পরও আমি খুশি, নদ খনন হচ্ছে। বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা হতো। ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যেত। কোনো ফসল হতো না। মানুষের ভীষণ কষ্ট হতো। এখন নদ খনন হচ্ছে, মানুষ কৃষিকাজ করতে পারবে। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা যাবে। বাড়ি গেছে, জমি গেছে, তাতে কষ্ট নেই। নদ খনন হচ্ছে, তাতেই আমরা খুশি।’ এভাবেই কপোতাক্ষ নদ খননে আশার কথা বলছিলেন, কপোতাক্ষ নদের পাড়ের বাসিন্দা খড়িয়াহাটি গ্রামের জিন্না সরদার (৬৫)।
আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পাইগাছা উপজেলার রাড়ুলী ও বাঁকারচর গ্রামের দূরত্ব জেলা শহর খুলনা থেকে ৬৫-৭০ কিলোমিটারের কম হবে না। এই এলাকার দুই দিকে সাতক্ষীরা জেলার সীমানা, একদিকে তালা উপজেলা, অন্যদিকে আশাশুনি। সেখানেই একসময় দাপট দেখাত কপোতাক্ষ নদ। তবে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০৬ সাল থেকে ঐ এলাকায় নদ তার অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। রোপা, আমন ও বোরো ধান তিন ধরনের ফসলের আবাদ হওয়া ২০ হাজার বিঘা জমি রূপ নেয় এক ফসলি জমিতে। এ অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (২য় পর্যায়) গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে।
প্রকল্পটিতে কপোতাক্ষ অববাহিকার জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে টিআরএমকে যুক্ত করে কপোতাক্ষ নদের উজান অংশে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে মনিরামপুর উপজেলার চাকলা ব্রিজ পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার ও নিচের অংশে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া থেকে কয়রা উপজেলার আমাদী পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার নদ খনন, তীর প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন, নিষ্কাশন অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামত করা, কপোতাক্ষ নদের দুই তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত করাসহ নদের সঙ্গে সংযুক্ত খাল খনন করা হবে।
সরকারি অর্থায়নে ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। এতে ব্যয় হবে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা। তাছাড়া এখানে পলি ব্যবস্থাপনা, টাইডাল প্রিজম বৃদ্ধি ও নিষ্কাশনক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৩৫ বছর মেয়াদি জোয়ার-ভাটা নদী ব্যবস্থাপনা (টিআরএম) কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে এক্সকাভেটরের মাধ্যমে খনন চলছে মরা কপোতাক্ষে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা ২০২৩ সালের মধ্যেই এখানকার কপোতাক্ষ আবার প্রাণ ফিরে পাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মধ্য জুন, মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে ভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে পাইকগাছা উপজেলার রাড়~লী ও বাকারচর গ্রামে। প্রায় এক যুগ ধরে মরা কপোতাক্ষের প্রভাবে যেখানে তিন ফসলি হাজার হাজার বিঘা জমি হয়ে উঠেছিল মানুষের গলার ফাঁদ।
বর্ষা মৌসুমে বাড়ি ছাড়তে হতো বাসিন্দাদের, এমনকি মৃত ব্যক্তির দাফন বা শেষকৃত্যও সম্ভব হতো না। সেখানেই মরা কপোতাক্ষের জোয়ার-ভাটার স্বপ্ন দেখছেন ১০ সহস্রাধিক কৃষক পরিবার। চরের বন্দোবস্ত জমিতে করা পাকা বাড়িঘর, জমি ও স্থাপনা হারিয়েও তাদের আক্ষেপ নেই। তারা এখন দীর্ঘ জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি, তিন ফসলি জমি চাষ করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন।
নদী বন্দর/এসএস