উত্তরের কৃষকের আমনের শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না। গত চার যুগেও বর্ষা, শরত বৃষ্টিহীন ছিল না। এই বক্তব্য বগুড়ার সত্তরোর্ধ বয়সী কৃষক বাসেত আলীর। আমন আবাদটি প্রকৃতির সেচ (বৃষ্টি) নির্ভর। আবহাওয়া বিভাগের কথা, গত দুই মাসে গড়ে স্বাভাবিকের তুলনায় অন্তত ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফসলের মাঠে খালি চোখে দেখা কৃষকের কথা- এর চেয়েও কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। যে কারণে শ্যালো টিউবওয়েল নামিয়েও কাজ হয়নি।
যারা গভীর নলকূপের পানি নিতে পেরেছে তারা কিছুটা আবাদ করতে পেরেছে। এভাবে দেখা যায়, উত্তরাঞ্চলে এখনও ২৫ শতাংশ জমিতে আমনের আবাদ হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অবশ্য জানিয়েছে, আমন চারা রোপণের সময় এখনও শেষ হয়নি। অপটিমাম পিরিয়ড ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চারা রোপণ করা যাবে। মাঠের কৃষক তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছেন, এই সময়ের মধ্যে চারা রোপণ করলে তা থেকে খড় মেলে বেশি। অনেক কৃষক গোখাদ্যের খড়ের জন্য আশি^ন মাসের শুরুতে (১৫ সেপ্টেম্বর) চারা রোপণ করে।
উত্তরাঞ্চলের আবাদউদ্বৃত্ত অঞ্চল বগুড়ার প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যমুনা ও বাঙালী তীরবর্তী এলাকার অনেক জমি এখনও পড়ে আছে। ক্ষুদ্র ও মধ্যম সারির কৃষক বৃষ্টির আশা করেছিল। সেই বৃষ্টি আর হয়নি। বৃষ্টি তো দুই সপ্তাহ নেই। আকাশে কালো মেঘ, ছাইরঙা মেঘ জড়ো হয়। বৃষ্টি আর হয় না। যে বৃষ্টি হয় তাতে জমি ভিজে না। ভিজলেও পরের ক’দিনের রোদে শুকনো ঠাঠা হয়ে যায়। অনেক কৃষক ডিপ টিউবওয়েলের সেচে চারা রোপণের জন্য জমি ভিজিয়ে নিচ্ছে। যারা পারছে না তারা অপেক্ষার পর হতাশ হয়ে যাচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলের কৃষক এখনও ঠাহর করতে পারে না, কখন চারা লাগাবে আর কখন পরিচর্যা করবে। প্রকৃত সময় শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই যারা জুন মাসে আগাম জাতের আমন চারা রোপণ করেছিলেন সেই চারা বেড়ে উঠছে। এখানেও বাদ সেধেছে আবহাওয়া। এই বৃষ্টি। কিছু পরই রোদ। রোদেলা আকাশের পর কালো মেঘ। তারপর মেঘ উধাও। কখনও আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি ঝরে না। আবার কখনও বৃষ্টি ঝরছে খুব কম। কৃষক এখন করবেটা কি! আমন আবাদ নিয়ে কৃষক আশাবাদী হতে পারছে না।
এদিকে বগুড়া সদরের উত্তরের কিছু এলাকা,পশ্চিমাংশের নন্দীগ্রাম এলাকা এবং চলনবিল এলাকায় যে কৃষক আগাম আমনের চারা রোপণ করেছিলেন সেই চারা বেড়ে উঠেছে। এর মধ্যে গত ক’দিন যে চড়া রোদ তাতে তারা এখন খরার ভয় করছে।
এবারের আমন আবাদের সর্বজনীন চিত্র হলো : প্রকৃতির সেচের (বৃষ্টি) বিঘœ ঘটায় আমন আবাদ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে এই ভাবনা ফুরোচ্ছে না কৃষককুলে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বললেন, গত বছরের বর্ষার এই সময়েও বৃষ্টিপাত ছিল। কৃষক বৃষ্টির পানিতে বীজতলা তৈরি করেছিল। চারা বড় হওয়ার পর রোপণ করেছে। পরিমিত বৃষ্টিপাতে আমন আবাদের ফলন ভাল হয়েছিল। এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
কোন কোন এলাকার কৃষক অধিক জমিতে সেচ দেয়ার জন্য গভীর নলকূপ চালু করে সমবায়ী ভিত্তিতে সেই পানির সেচ দিচ্ছে। বগুড়া সদরের কৃষক খলিলুর রহমান বললেন, তিনি কয়েক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে আমন আবাদ করেছেন। প্রকৃতির অধিক তাপে কুলানো যাচ্ছে না। কোন রকমে চারা রোপণের পরই তা কাঠফাটা রোদে পুড়ে যেতে থাকে। সাধারণত এই সময়ে চারা বেড়ে উঠলে কৃষক আগাছা পরিষ্কারের জন্য পরিচর্যা শুরু করে দেয়। এবার কৃষক বুঝতেই পারছে না কখন চারা রোপণ করবে। কখন তা বড় হবে। কখন পরিচর্যা করবে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দুলাল হোসেন জানান, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমন চারা রোপণ করা যায়। এর আগে কৃষক আলু, সবজি আবাদ করে ঘরে তুলছে। বগুড়া অঞ্চলে চলতি আমন মৌসুমে টার্গেট করা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৭৬ হেক্টর জমি। এ থেকে চাল আকারে উৎপাদন টার্গেট অন্তত সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন। এদিকে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এবার বৃষ্টিপাত খুব কম। মৌসুমিবায়ু দুর্বল হয়ে কম সক্রিয়। ফলে বৃষ্টির বদলে তাপ বেশি। এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে উষ্ণায়ন পৃথিবীর ফেরে পড়ে বাংলাদেশেও তাপ বেড়েছে। প্রতিটি দুর্যোগে কৃষক বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে মাঠে নামে। এবারও তাই নামছে।
নদী বন্দর/এসএইচ