সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল আমিয়ান গ্রাম। এ গ্রামের বেশির ভাগ চাষি চিংড়ি চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রক্রিয়াকরণ কারখানা না থাকায় এসব চিংড়ি ফড়িয়াদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হতেন তাঁরা। কিন্তু গ্রামটির চাষিদের ভাগ্যবদল শুরু হয়েছে।
খন ভালো দামে সরাসরি কারখানায় চিংড়ি বিক্রি করতে পারেন তাঁরা। তাঁরা ভালো পোনা ও প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, ফলে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনও বেড়েছে। সামগ্রিক আয় বৃদ্ধির কারণে গ্রামের চিংড়ি চাষিদের জীবনে কিছুটা উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে।
স্থানীয় চিংড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, এসিআই অ্যাগ্রো লিংক লিমিটেড ২০১৯ সালে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার আমিয়ান গ্রামে বাগদা চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট নির্মাণ ও চালু করে। কিন্তু শুরুতে তারা এলাকার মানুষের মধ্যে চিংড়ি চাষ নিয়ে প্রথাগত ধারণার পরিবর্তন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেয়। গ্রামটির নাম অনুসারেই এসিআই তাদের মৎস্য ও চিংড়িজাত পণ্যের ব্র্যান্ড নাম রেখেছে ‘আমিয়ান’। ফলে চিংড়ির কল্যাণে সাতক্ষীরার আমিয়ান গ্রামের নাম এখন বিশ্ববাজারে।
এসিআই গ্রুপের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাদের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে এক হাজার ৭২৭ টন মাছ রপ্তানি করে ১২৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা আয় করে। তাদের এসব মাছ যাচ্ছে ইউরোপসহ বিশ্বের ১০টির বেশি দেশে। সামনের দিনে আরো পাঁচটি দেশে রপ্তানি বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
গত দুই বছরে ইউরোপ ছাড়া এশিয়ার কয়েকটি দেশে গেছে আমিয়ান ব্র্যান্ডের চিংড়ি ও মৎস্যজাত পণ্য। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে জাপান, স্পেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং বেলজিয়ামে।
এসিআইয়ের রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে এখনো কোনো র্যাপিড অ্যালার্ট জারি হয়নি। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদনে এইচএসিসিপি অনুসরণ করে থাকে তারা। প্রতিষ্ঠানটিতে সার্বক্ষণিক ৬৩ জন এবং খণ্ডকালীন ২৪১ জনসহ মোট ৩০৪ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে। আমিয়ান গ্রামের পাশাপাশি এখন আশপাশের গ্রামেও এর সুফল পৌঁছে গেছে।
এ বিষয়ে পাশের নলতা গ্রামের মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস ধরেই দেখছি আমিয়ান গ্রামের চিংড়ি চাষিরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। তাঁদের মাছের ঘেরে মাছের উৎপাদনও বাড়ছে। আবার রোগবালাইও কম হচ্ছে। এ জন্য আমি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখন এসিআইয়ের সহায়তা নিয়েছি। আমিও ভালো লাভবান হব বলে আশা করছি। এরই মধ্যে চারবার তাদের কারখানায় চিংড়ি দিয়েছি।
এসিআই অ্যাগ্রো লিংকের মহাব্যবস্থাপক মো. সোয়েব মাহমুদ বলেন, এখানকার খামারিদের মানসম্পন্ন পোনা সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাছের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি একটি মডেল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তিনি জানান, প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় বর্তমানে সাতজন এজেন্টের মাধ্যমে দুই শতাধিক কৃষকের কাছ থেকে প্রতিদিন চিংড়ি কেনা হয়। অন্যান্য বাজারের চেয়ে বেশি দাম পান এখানকার কৃষকরা।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে রপ্তানি করা এবং দেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখায় এসিআই অ্যাগ্রো লিংক লিমিটেডের কালীগঞ্জের আমিয়ান ব্র্যান্ড এবার জাতীয় মৎস্য পুরস্কার পায়। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফা হ আনসারীর হাতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পুরস্কার তুলে দেন কৃষিমন্ত্রী মো আব্দুর রাজ্জাক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চিংড়ির রপ্তানি বাজার সংকুচিত হচ্ছে। গুণগত মান রক্ষা না করা, চিংড়িতে অপদ্রব্য মেশানোর অভিযোগ বেশ পুরনো। বাজার ধরে রাখতে চিংড়িকে বৈশ্বিকভাবে আরো প্রতিযোগী করে তুলতে হবে। যেমন মাদাগাস্কারে প্রতি কেজি চিংড়ি ১৯ ডলারে বিক্রি হয়। আর বাংলাদেশের চিংড়ি বিক্রি হয় মাত্র ১০ ডলারে। উৎপাদনশীলতায়ও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি মাছ উৎপাদিত হয় মাত্র ২৮০-২৯০ কেজি। ভারত এবং ভিয়েতনামে সেটি ৯০০ কেজি হয়।
মান কিভাবে ঠিক রাখা যায়—জানতে চাইলে এসিআই অ্যাগ্রো লিংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফা হ আনসারী বলেন, মৎস্য পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখার জন্য দ্রুত সময়ে মাছ প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে এই কার্যক্রম শেষ করতে হয়। এতে মাছ ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয় না। তিনি বলেন, তাঁদের কারখানায় এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আধুনিক যন্ত্র যেমন আনা হয়েছে, তেমনি ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়াতে কর্মীদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি মাছে কোনো ধরনের অপদ্রব্য যেন যেতে না পারে, সে জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের তদারকির পাশাপাশি তাঁদের নিজস্ব মান পরীক্ষা দল কাজ করে।
ফা হ আনসারী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের চিংড়ি বিশ্বের বুকে ব্র্যান্ডিং করছি। শুধু চিংড়ি নয়, সাদা মাছও প্রক্রিয়াজাত শুরু করব। বিশ্বের যেসব দেশে চিংড়ি ও সাদা মাছের চাহিদা রয়েছে, সেখানে রপ্তানির বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি। আমাদের প্রক্রিয়াকরণ কারখানাটি মূলত চিংড়িঘেরের মধ্যে করা হয়েছে। এটির সক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। ’
নদী বন্দর/এসএইচ