আমড়ার কথা উঠলে দেশের যে অঞ্চলটির নাম প্রথমেই মনে পড়ে, সেটি হলো বরিশাল। সুস্বাদু ও মিষ্টি হিসেবে বরিশালের আমড়ার সুখ্যাতি দেশব্যাপী। এই আমড়ার সিংহভাগ ফলন হয় পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলায়। ৭০-৮০ বছর ধরে এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে আমড়ার আবাদ চলছে।
এ বছর এলাকাটিতে আমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। এর আগে যোগাযোগের দুরাবস্থা ও গত দু’বছর করোনার প্রভাবে তেমন পাইকারি ক্রেতা না আসায় ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন এখানকার চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ বছর পদ্মা সেতু চালু ও করোনা সংক্রমণ শিথিল হওয়ায় এখানকার আমড়া চাষি ও ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটেছে। আগের ক্ষতি পুষিয়ে এবার লাভবান হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তারা।
উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পাওয়া তথ্যমতে, উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেই কম-বেশি আমড়ার চাষ হয়। তবে আটঘর কুড়িয়ানা, জলাবাড়ি ও সমুদয়কাঠি ইউনিয়নের ১৬০ হেক্টর জমিতে এর বড় একটি অংশের চাষ হচ্ছে। এ বছর প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৫ থেকে ২০ মেট্রিক টন আমড়া উৎপাদিত হয়েছে। আমড়ার চাষ ও বিপণন ব্যবস্থার সাথে ওই এলাকার প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার শ্রমজীবী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
এটিই তাদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত আমড়ার মৌসুম। আমড়া ও পেয়ারার পাশাপাশি এসব এলাকায় লেবু, গাব, নারিকেল, পান ও সুপারিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাষ হয়।
উপজেলার কুড়িয়ানা, আটঘর, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, ধলহার, আতা, মাদ্রাসহ ছোট-বড় অন্তত ১০টি খালে প্রতিদিনই আমড়ার ভাসমান হাট বসে। চাষিরা বাগান থেকে আমড়া সংগ্রহ করে বিক্রির উদ্দেশ্যে নৌকা ও ট্রলারে করে হাটে নিয়ে যান। আমড়া কেনা ও সরবরাহের জন্য ওই হাটে ব্যবসায়ীরা অস্থায়ী আড়ত নির্মাণ করেছেন। আড়তগুলোতে পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও কাজ করেন।
পুরুষ শ্রমিকরা প্রতিদিন আট থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করে ৬শ থেকে ৮শ টাকা এবং নারী শ্রমিকরা প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা কাজ করে ৪শ থেকে ৫শ টাকা মজুরি পান। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কাজে সরগরম হয়ে ওঠে হাট ও আড়ত। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আমড়া বেচাকেনা। সন্ধ্যার পর থেকে শ্রমিকরা আমড়া বাছাই করে প্লাস্টিকের ক্রেট, বস্তা ও ঝুড়ি ভর্তি করেন। গভীর রাত পর্যন্ত ট্রাকে আমড়া তোলার কাজ চলে। কেউ আবার লঞ্চযোগেও আমড়া সরবরাহ করেন।
বর্তমানে হাটে পাইকারিভাবে মণপ্রতি আমড়া ৭শ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছর আমড়ার এ মৌসুমে ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের এক শ্রেণীর পাইকার এখান থেকে হাজার হাজার মণ আমড়া কিনে লঞ্চ, ট্রাক ও পিকআপযোগে নিয়ে যান। অপরদিকে, স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও প্রতিদিন শত শত মণ আমড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান দেন।
বিগত বছরগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ আশেপাশের এলাকায় আমড়া পৌঁছতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। ফলে পথে অনেক আমড়া পচে নষ্ট হতো। এতে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি হতো।
তার প্রভাব গিয়ে পড়ত চাষিদের ওপর। তারা আমড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতেন। এ বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ী ও চাষিরা বেশ আনন্দিত। সড়কপথে এখানকার আমড়া ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরাও ভালো দাম পাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে কুড়িয়ানা বাজারের ব্যবসায়ী মো. হক মিয়া জানান, আগে হাট থেকে আমড়া ক্রয় করে লঞ্চযোগে পরদিন রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতাম। অথবা, সড়কপথে মাওয়া ফেরিঘাটে আটকা পড়লে সেখানেই অনেক আমড়া নষ্ট হয়ে যেত। এ বছর পদ্মা সেতুর কল্যাণে দিনের আমড়া সেদিনই ঢাকায় পৌঁছাতে পারছি। তাই ক্ষতির ঝুঁকি কম, দামও ভালো পাচ্ছি।
ব্যবসায়ী শহিদ মল্লিক জানান, এ বছর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় আমরা হাটে বসেই পিকআপ ও ট্রাকে আমড়া বোঝাই করতে পারছি। ঢাকাসহ অন্য এলাকায় আমড়া সরবরাহে সমস্যা না থাকলেও চাঁদপুরে আমড়া নিতে হরিনাঘাট সংলগ্ন সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে অনেক বেগ পোহাতে হয় তাদের।
আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় গোটা দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ও ব্যবসায়ের যে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তার প্রভাব এই এলাকাতেও পড়েছে। সেতুর কল্যাণে এ বছর এই এলাকার আমড়া ও পেয়ারা চাষি এবং ব্যবসায়ীরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। এছাড়াও এখানকার হিমানন্দকাঠি ব্রিজটি চালু হওয়ায় হাটে বসেই ব্যবসায়ীরা ট্রাকে ও পিকআপে তাদের মালামাল তুলতে পারছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ বলেন, কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে এখানকার আমড়া চাষিদের প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর আমড়া গাছের রোগ ও পোকা নিধনের ওপর কৃষি অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা আমড়া বাগানে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেন।
নদী বন্দর/এসএইচ