পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ভরা বর্ষায়ও ফরিদপুরের নদ-নদী, খাল-বিলে, পুকুর ও ডোবায় পানি নেই। ফলে এবার পাটের ভালো ফলন হলেও জাগ দেওয়া যাচ্ছে না। পানি অভাবে সোনালী আঁশ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ক্ষেতেই পাট ফেলে রেখেছেন তারা।
জানা গেছে, এ জেলা পাট উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। গুনে-মানে আছে সুখ্যাতি। এবার অনাবৃষ্টির কারণে চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাষিদের চরম ভোগান্তি ও কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি সঠিকভাবে পাট পচাতে না পারলে আঁশের মানও এবার নিম্নমুখীর শঙ্কা আছে। মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া পাটচাষিরা লোকসান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
কৃষকরা জানান, গত বছর পাটের দাম ভালো পাওয়ায় এবার পাট আবাদ বেশি হয়েছে। প্রখর রোদ, অনাবৃষ্টির কারণে পাট চাষের বিভিন্ন এলাকায় আছে পানির সংকট। প্রতি বিঘায় পাট চাষে কমপক্ষে ৯-১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফলন যদি ভালো হয় তাহলে প্রতি বিঘায় ৯-১০ মণ পাটের ফলন পাওয়া যায়। তবে এতো সমস্যার পর যদি কাঙ্ক্ষিত দাম না মেলে তাহলে মাথায় হাত।
কৃষি বিভাগ বলছে, পাট পচানোর পানির অভাবে এবার চাষিরা বিপাকে পড়েছেন। চাষিদের রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাটের আঁশ ছাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ১০ লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয়। এ পদ্ধতিতে পাট পচালে আঁশের মান ভালো থাকে। চাষিদের এ বিষয়ে পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, ফরিদপুরে বেশিরভাগই তোষা জাতের পাট চাষ হয়েছে। জেলায় এবার ৮৭ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এবারও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পাট চাষ করেছেন কৃষকরা।
জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চাষিরা পাট কেটে জমির পাশে বা রাস্তার ধারে, খাল-বিল বা জলাশয়ের পাশে স্তূপ করে রেখেছেন। কেউ আবার অল্প পানিতেই পাটের ওপর মাটি চাপা দিয়ে পাট জাগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। জেলা-উপজেলার হাজার হাজার কৃষক পাট জাগ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না। ফলে অনেকের পাট এখনো ক্ষেতেই। কেউ কেউ পুকুর, খাল কিংবা পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে খাল-নদীতে নিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন।
অনেকে আবার মাটি গর্ত করে, পুকুরে-রাস্তার খাদে স্যালোমেশিন দিয়ে পানি জমিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে কষ্ট ছাড়াও অতিরিক্ত খরচ বাড়ছে পাটচাষিদের।
সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের কৃষক খালেক মাতুব্বর বলেন, বৃষ্টি নেই। নদী-খাল-বিল ও পুকুরে পানি নেই। খরার কারণে পুড়ে লাল হয়ে যাচ্ছে। পাট কেটে কোথায় জাগ দেবো। বেশি দামে শ্রমিক নিয়ে ভ্যান ও নসিমনে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নিয়ে রাস্তার পাশে খাদের পানিতে নিয়ে পাট জাগ দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড দাবদাহে এবার পাট কাটতে গত বছরের তুলনায় শ্রমিক খরচ বেশি হয়েছে। আড়াই বিঘা জমির পাট কেটে খুব কষ্টে জাগ দিয়েছি।
এ বিষয়ে পুলিয়া গ্রামের কৃষক মোতালেব হোসেন বলেন, আড়াই বিঘা জমির পাট কেটে নানা জায়গায় জাগ দিয়েছি। পুকুর ভাড়া করেও পাট জাগ দিয়ে আমন আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছি। এবার পাটের রঙ ভালো হবে না মনে হচ্ছে। আগামী বছর এত জমিতে আর পাটের আবাদ করবো না ভাবছি। সোনালি আঁশের পাট যেন আমাদের গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে।
বোয়ালমারীর রূপাপাত ইউনিয়ন টোংরাইল গ্রামের পাটচাষি মহানন্দ বিশ্বাস বলেন, ভরা বর্ষায় বৃষ্টি না হওয়ায় বেশিরভাগ কৃষকের জমিতেই পাট রয়ে গেছে। পাট কাটার সময় হলেও জাগ দেওয়ার সমস্যায় পাট কাটতে পারছি না। বাড়ির সামনে একটি খাল আছে, পানি সামান্য। কিন্তু সেখানে সবাই পাট জাগ দিচ্ছেন। তাই জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।
শেখর গ্রামের বাসিন্দা প্রবীর সরকার বলেন, ফলন ভালো হলেও পাট জাগ দেওয়া নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বেকায়দার যেন শেষ নেই। ভ্যানে করে ক্ষেত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পুকুরের অল্প পানিতে কোনোমতে মাটি চাপা দিয়ে জাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
চতুল গ্রামের ধুলপুকুরিয়া গ্রামের কামরুল ইসলাম বলেন, সারের মূল্য বৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আবার শ্রমিকের মজুরিও বেশি। কোথাও পানি নেই। পাট জাগ দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হচ্ছে। খাদ-পুকুর ভাড়া নিয়ে স্যালোমেশিনে পানি ভরে পাট জাগ দিতে হচ্ছে। ক্ষেত থেকে পাট মাথায় রাস্তায় ফেলা হচ্ছে আবার সেখান থেকে ভ্যানে কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে নিতে হচ্ছে। আগামীবার আর এত জমিতে পাটের আবাদ করবো না ভাবছি। জানে আর কুলায় না।
এ বিষয়ে ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, পানির অভাবে পাট জাগ দিতে কৃষকের কষ্ট হচ্ছে। পানির অভাবে চাষিরা বিপাকে পড়েছেন এটা ঠিক। আমরা চাষিদের রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাটের আঁশ ছাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছি। এ পদ্ধতিতে পাট পচালে আঁশের মান ভালো থাকে।
তিনি আরও বলেন, সামনে বৃষ্টি-বর্ষায় নদ-নদী-খালে পানি বাড়লে হয়তো এ সমস্যা কিছুটা কেটে যাবে। এরপরও অনাবৃষ্টি হলেও পাটের উৎপাদন খুব বেশি ব্যাহত হবে না। সবকিছু মিলিয়ে আমরা আশা করছি জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
নদী বন্দর/এসএইচবি