খরা ও অনাবৃষ্টিতে ফলন ভালো হলেও সোনালি আঁশ ঘরে তোলা নিয়ে চিন্তিত কৃষক। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না তারা। অতিরিক্ত খরায় খেতে পাট শুকিয়ে নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকে পুকুর ভাড়া করে জাগ দিচ্ছেন। ফলে খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে আঁশের মানও। তাই ভালো ফলনেও হাসি নেই চাষিদের মুখে।
আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ মাসের শুরুতেও জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হওয়ায় চাষিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জেলার অধিকাংশ খাল-বিল পানিতে ভরপুর থাকার কথা থাকলেও এখন শুকনো। কোনো কোনো জলাশয়ে সামান্য পানি থাকলেও পাট পচানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। অচিরেই ভারী বৃষ্টি না হলে সোনালি আঁশ পাট চাষিদের গলার ফাঁস হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন এ এলাকার পাট চাষিরা।
মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের পাট চাষি শানু আকন বলেন, ‘বড় বিপদে আছি বাপু, পাঁচকানি জমিনে পাট বুনছি, চকে পানি নাই, পাট জাগ দিতে পারছি না। সব পাট হুলা জমির ওপর। নষ্ট হইয়া পইড়া গেছে।’ পাট আর চাষ করমু না।
অন্যান্য কৃষকেরা জানান, ৩৪০ শতাংশ জমিতে পাট চাষ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছিল। কিন্তু বর্ষা ভরা মৌসুমেও পানি চলে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পানির অভাবে মাঠে থাকা পাটগুলো পচাতে পারছেন না। এমনকি শুকনো জমিতে পাট কাটার পরে পানির অভাবে সেগুলো মাথায় করে নিয়ে আসতে হচ্ছে। কেউ কেউ আবার শুকনো জমিতে পাট কেটে সেগুলো পাতা ছড়ানোর জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। সময়মতো পাটগুলো পচাতে না পারলে সোনালি আঁশ সোনালি রং ধারণ করবে না বলে চাষিদের আশঙ্কা।
মাঠ ঘাটে পানি না থাকায় পাট পচানো নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন সদর উপজেলার, ঝাউদি, আলিনগর, ঘটমাঝি ছিলারচর, কালিকাপুর, পাঁচখোলা এবং খোঁয়াজপুর ইউনিয়নের পাট চাষিরা। চাষিদের শঙ্কা সময় মতো পাট কেটে পচাতে না পারলে পাটের রং সুন্দর হবে না, ন্যায্য মূল্যও পাবে না তারা। সারা বছরের পরিশ্রমই বিফলে যাবে তাদের।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোঁয়াজপুর ও ঝাউদি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মাঠে-ঘাটে, খালে-বিলে তেমন পানি নেই। কোথাও পুরোপুরি শুকনো অবস্থায় চাষিদের পাট কাটতে হচ্ছে। মাথায় করে সে পাট পচানোর জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে পারিবারিক পুকুরে, যেখানে গ্রামের মানুষেরা গোসল করে থাকে। এর ফলে দূষিত হচ্ছে পুকুরের পানি। পুকুরের আবদ্ধ ওই দূষিত পানি দিয়ে গোসল এবং রান্না করার ফলে নানা পানিবাহিত রোগেরও আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে পাট চাষের জন্য জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে পাটগাছ কাটা, জাগ দেওয়া (পচানো), পরিষ্কার ও শুকানো পর্যন্ত যে টাকা খরচ হয়েছে সে তুলনায় বাজারে দাম অনেক কম। ফলে চরম লোকসানে পড়ছেন মাদারীপুরের পাটচাষিরা। তাদের দাবি, পাটের দাম একটু বাড়ানো হলে লোকসানের সংখ্যা একটু কম হবে।
ঝাউদি ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার কৃষক আব্দুস রসিদ আকন বলেন, এ বছর পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু পানি না থাকায় তা কাটা হচ্ছে না। যা কর্তন করা হয়েছে সেগুলো জাগ দিতে না পারায় রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও বলেন, সরকার সব কিছুর দাম বাড়িয়েছে, শুধু বাড়ায়নি পাটের দাম। এ অবস্থায় পাটের দাম বাড়ানো প্রয়োজন।
খোয়াজপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর এলাকার কৃষক আব্দুল জব্বার জানান, আমার তিন বিঘা জমিতে এবার পাট চাষ করেছি। ফলন ভালো হলেও পানি না থাকায় আমার পুকুরের মাছ মেরে দিয়ে পাট জাগ দিতে হয়েছে। পাট আবাদের শুরুতে নীচু জমির কিছু পাট বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়। এখন টানা খরার কারণে পাট জাগ দেওয়ার পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
আরেক পাটচাষি সেলিম ব্যাপারী বলেন, এ বছর পাট নিয়ে বড় বিপদে আছি। আমার অল্প কিছু পাট, হেইডাও জাগ দিতে পারতেছি না, ৮/১০দিন ধইরা পুকুরে ফালাই রাখছি।
পাটচাষি আমির হোসেন তিনি বলেন, ‘এবছর পাট আবাদে আমাদের বেশি খরচ হয়েছে। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর কীটনাশক খরচ করতে হয়েছে। এতো খরচ আর পরিশ্রমের পর যদি ভালো দাম না পাই তাহলে আর পাটচাষ করবো কী না, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সন্তোষ চন্দ্র জানান, ‘সাধারণত মাদারীপুর জেলায় বর্ষা মৌসুমে পানির সংকট হয় না। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এ বছর আমাদের চাষি ভাইদের পাট নিয়ে কষ্ট করতে হচ্ছে।’
নদী বন্দর/এসএইচবি