ব্রুনাইয়ে প্রথম গিয়েছিলেন শ্রমিক হিসেবে। এরপর দেশটিতে থেকে এক নারীর সঙ্গে যৌথভাবে, কখনও এককভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানো শুরু করেন। কখনও ওয়ার্ক পারমিটে, কখনও টুরিস্ট ভিসায় মানবপাচার করতেন দেশটিতে মানবপাচারের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজন।
নিজের বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি না থাকলেও ব্রুনাইয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘নামসর্বস্ব’ ১৫টি কোম্পানির চাহিদায় বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে লোক পাঠাতেন তিনি।
সর্বশেষ চার শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে তিন কোটি টাকা নিয়ে মাত্র ৬০ জনকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যায় বিজনচক্র। কাজ না পেয়ে দেশটির রাস্তায় কাটতে থাকে তাদের দিন। পরে পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় গত জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন তারা। দেশে ফিরেই বিজনসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মানবপাচার ও প্রতারণা আইনে অন্তত ২১টি মামলা করেন ভুক্তভোগীরা।
গত বুধবার র্যাব-৩ এর একটি দল বিজনের অন্যতম সহযোগী শেখ আমিনুর রহমান হিমুকে গ্রেফতার করে। একইসঙ্গে তার দুই সহযোগী নূর আমিন ও বাবুল রহমানকে অস্ত্রসহ কাফরুল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে মানবপাচার মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের দুদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তবে এখনও অধরা রয়েছেন ব্রুনাইয়ে মানবপাচার চক্রের প্রধান মেহেদী হাসান ওরফে বিজন (২৮)।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার জনকে পাচার করা হয়েছে। হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বিজন ও তার অন্য সহযোগীরা ঢাকাতেই আছেন। কৌশলে গা ঢাকা দিয়েছেন। ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি এড়িয়ে চলছেন।
সর্বশেষ রাজধানীর কাফরুল থানায় দুটি মামলা করেন প্রতারণার শিকার হয়ে ব্রুনাইয়ে যাওয়ার পর ফিরে আসা দুই ভুক্তভোগী। মামলা নং- ৩৫ ও ৩৬। দুই মামলাতেই চক্রের মূলহোতা হিসেবে উঠে এসেছে বিজনের নাম।
র্যাব-৩ সূত্রে জানা যায়, প্রতারণার অভিযোগে মেহেদী হাসান বিজন ও তার সাত সহযোগীর পাসপোর্ট বাতিল করে ব্রুনাইয়ের সরকার কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরে সারাবিশ্বে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মেহেদী হাসান বিজনসহ পাঁচজনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তাদের একজন কম্বোডিয়া এবং আরেকজন মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, মেহেদী হাসান বিজন নয় বছর আগে শ্রমিক ভিসায় ব্রুনাইয়ে যান। তার বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে তাকে চেনেন না। তার বাবা মোস্তাকিন হাসান পেশায় কৃষক।
মানবপাচার মামলাগুলো থানা পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত করছে র্যাব। র্যাব-৩ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেহেদী হাসান বা তার সহযোগীদের নামে বাংলাদেশে কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্স (আরএল) নেই। তারা আরএল আছে এমন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রুনাইয়ে লোক পাঠিয়ে প্রতারণা করতেন বা পাঠানোর কথা বলে টাকা নিতেন।’
মানবপাচার মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ব্রুনাইতে বাংলাদেশি মালিকানায় প্রায় তিন হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত আছে। যার অধিকাংশই নামসর্বস্ব। দালালচক্র ও রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি মিলে ব্রুনাইয়ে এসব নামসর্বস্ব কোম্পানিকে ‘ভালো কোম্পানি’ আখ্যা দিয়ে মানবপাচার করতেন। দেশটিতে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক অবস্থান করছেন। এসব শ্রমিকের বড় একটি অংশ মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ব্রুনাই আসেন। বর্তমানে সেখানে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
দেশটিতে কাজের বন্দোবস্ত না হওয়ায় ফিরতে হয়েছে অনেক শ্রমিককে। ব্রুনাইয়ে মানবপাচারে ডিএল ব্যবহৃত হয়েছে রাজধানীর নয়াপল্টনের হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল ও কিশোরগঞ্জের নজরুল ইন্টারন্যাশনালের।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে ব্রুনাইয়ে যান নরসিংদীর রায়পুরার বড়চর গ্রামের মাসুদ। সেখানে যাবার পর জানতে পারেন, কাজে নয় পাচারের শিকার তিনি। প্রতিবাদ করায় তাকে শারীরিকভাবে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনকালে তার হাতের একটি আঙুল কেটে ফেলে বিজন দালালচক্রের সদস্যরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, ব্রুনাইয়ে থাকার সময় মেহেদী হাসান বিজন বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতেন। মানবপাচার করে হাতিয়ে নেয়া টাকায় কেনা বুলেটপ্রুফ হামার এইচ-২ গাড়ি চালাতেন। এমন শত শত ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন সিআইডি ও র্যাব কার্যালয়ে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার সামসুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচারের পাঁচটি মামলা আমাদের টিম তদন্ত করছে। অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট তদন্ত করছে একটি। মেহেদী হাসান বিজনের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গত ৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দেন। সেটি আসে সিআইডির হাতে। পরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিজনের সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, গ্রেফতারের খবর শুনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ আমাদের কাছে আসতে থাকেন। সবারই অভিযোগ, কাজ দেয়ার নামে বিদেশে নিয়ে প্রতারণা করেছে চক্রটি। আমরা এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের মধ্যে রহিম নামে একজন রয়েছেন যিনি নিজেও শ্রমিক হিসেবে ব্রুনাইয়ে গিয়ে পরবর্তীতে মানবপাচার চক্রে জড়িয়ে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, মেহেদী হাসান বিজনসহ অন্যান্য চক্রের মাধ্যমে যারা ব্রুনাইয়ে গেছেন আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তারা বৈধ ভিসায় ব্রুনাই গেছেন। সেখানকার কোম্পানিগুলোই ভিসাগুলো পাঠাচ্ছে। কিন্তু তারা নামসর্বস্ব। ওই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর যোগসাজশ রয়েছে। বিজনের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে ১৫টির মতো কোম্পানি।
‘মানবপাচারের ব্যবসা করে বিজন বাড়ি-গাড়ি-অর্থসম্পত্তি গড়েছেন। আমাদের তদন্ত চলছে। প্রমাণসাপেক্ষে আমরা জড়িত রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করব’— বলেন সামসুন নাহার।
এদিকে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজন। হিমু দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন, বিজনের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। গ্রেফতার হিমু বিজনের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ব্রুনাইয়ে মানবপাচার করতেন। আমরা জেনেছি, বিজন ঢাকাতেই আছেন। তাকে গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
কাফরুল থানায় দায়ের হওয়া দুই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, একই অভিযোগে উত্তরা পূর্ব থানাতেও একটি মামলা হয়েছে। তিন মামলাতেই অভিযুক্ত বিজন, হিমু, আব্দুল্লাহ আল মামুন অপু। এর মধ্যে হিমু র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। অপু অবস্থান করছেন ব্রুনাইতে। চক্রের মূলহোতা বিজনকে গ্রেফতার করতে পারলে পুরো চক্রটিকে ধরা সম্ভব। সে চেষ্টা চলছে।
অভিযুক্ত হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিএমবিটি ও বায়রার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। আমি যদি সরকারের যেসব নিয়মনীতি রয়েছে, সেসবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে লোক পাঠিয়ে থাকি, তাহলে আমি শাস্তি মেনে নেব। এখন পর্যন্ত আমরা এজেন্সির বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ মন্ত্রণালয় জমা পড়েনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জাগো নিউজকে বলেন, জনশক্তি রফতানি তো বললেই হয় না। অনেক প্রক্রিয়া ও নীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ব্রুনাইয়ের কোনো কোম্পানি চাহিদা দিলে আমরা বৈধ কাগজপত্র চাই। সেসব আসার পর সেখানকার সরকারের অনুমোদনে ভিসা আসে। এরপর আমরা সংশ্লিষ্ট দেশীয় দূতাবাসে, অধিকাংশ সময় মন্ত্রণালয়ে কাগজ জমা দেই। কল্যাণ ফান্ডে সাড়ে তিন হাজার টাকাও জমা দেই। এরপর সরকার অনুমোদন দিলে লোক পাঠাই।
‘এখন বিদেশে যাবার পর যদি কেউ নির্যাতিত হন বা চাকরি না হয়, ভুঁইফোড় কোম্পানি হওয়ায় বিপদে পড়ে, সে দায় তো আমাদের নয়। তাহলে দূতাবাস, মন্ত্রণালয় বা বিএমইটি কী করেছে? তারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেছে। সংশ্লিষ্টরা যদি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন, তারা আমাদের বলতেন, কোম্পানি ভুঁয়া, লোক পাঠানো যাবে না, আমরা পাঠাতাম না।’
তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের যদি মানবপাচারকারীর কাতারে ফেলা হয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। আমি বলব, আইন বা নিয়মনীতি ব্যত্যয় ঘটিয়ে যদি কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি জনশক্তি পাঠানোর নামে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে এবং যদি এর প্রমাণ মেলে তাহলে যেকোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়ায় বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।