স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আর থাকছে না। এটি বিলুপ্ত করে পানিসম্পদ অধিদপ্তরে রূপান্তর করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) পানিসম্পদ নামে নতুন একটি ক্যাডার যোগ করা হচ্ছে। নিয়োগ দেওয়া হবে বিসিএসের মাধ্যমে।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে আত্মপ্রকাশ করা পাউবো বিলুপ্ত করে পানিসম্পদ অধিদপ্তর করতে এরই মধ্যে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সেটির ওপর বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নেওয়ার কাজও শেষ পর্যায়ে। এরপর মন্ত্রিসভার অনুমোদন মিললে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষ করে তা পাঠানো হবে জাতীয় সংসদে। সংসদে আইনটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে দীর্ঘ ৪৮ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে বিলুপ্ত হবে পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০।
এদিকে পাউবো বিলুপ্তি প্রক্রিয়ার শুরুতেই বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। তথ্য বলছে, পাউবোতে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বা নবম গ্রেডে দুইভাবে নিয়োগ হয়। একটি সহকারী প্রকৌশলী পদে, অন্যটি সহকারী পরিচালক পদে। পদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় (৪৬৩ পদ) বোর্ডে সহকারী প্রকৌশলীরা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। অন্যদিকে সহকারী পরিচালক বা (সাধারণ পেশা) পদের সংখ্যা কম থাকায় (২০৯) তাঁদের অবস্থান দুর্বল।
জটিলতা দেখা দিয়েছে খসড়া বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদপ্তর আইনের ২৪-এর ঘ ধারা নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী প্রকৌশলী পদে যাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা অধিদপ্তরে পানিসম্পদ প্রকৌশল নামে সাবক্যাডারের সদস্য হবেন। অথচ সহকারী পরিচালকদের বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। ফলে বোর্ডে সহকারী পরিচালক পদে কর্মরতরা আশঙ্কা করছেন যে পাউবো বিলুপ্ত হয়ে গেলে তাঁদের পদ ব্লক হয়ে যাবে। ফলে ভবিষ্যতে তাঁদের পদোন্নতির সুযোগ থাকবে না। আর নেই আশঙ্কা থেকেই তাঁরা বিষয়টির উল্লেখ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, খসড়ায় সহকারী পরিচালকদের নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ না থাকার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রী ও সচিবদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। আশা করা হচ্ছে, দ্রুতই এর সুরাহা হবে।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রোকন উদ দৌলা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিলুপ্ত করে পানিসম্পদ অধিদপ্তর করার কাজ এগিয়ে চলেছে। এখন বোর্ডে ঢোকার পর অনেক সহকারী প্রকৌশলী সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় অন্যত্র চলে যান। ফলে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। কাজের মানও কমে যায়। অধিদপ্তরে রূপ পেলে সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। নিয়োগ দেওয়া হবে বিসিএসের মাধ্যমে। ফলে চাকরি ছেড়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতাও কমবে।
আইনের খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিদপ্তরে একজন মহাপরিচালক থাকবেন। এর প্রধান কার্যালয় থাকবে ঢাকায়। সংস্থাটির কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকার দেশের যেকোনো স্থানে এর শাখা খুলতে পারবে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের সব নদ-নদী, জলাধার, ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবস্থাপনা করবে। বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পগুলো পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে অধিদপ্তর।
খসড়ায় বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অধিদপ্তরেও সেই পদে বদলি ও পদায়ন করা হবে। অধিদপ্তর গঠনের পর সহকারী প্রকৌশলী ও সহকারী পরিচালক পদ ছাড়া অন্যান্য সমমানের পদ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পানিসম্পদ ক্যাডারের অধীনে পানিসম্পদ সাধারণ সাবক্যাডার সার্ভিস পদ হবে। এ ছাড়া আন্ত ক্যাডার জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করবে সরকার।
উদ্যোগটিকে কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে পাউবোর সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড চলে নিজস্ব নিয়মনীতির মাধ্যমে। অধিদপ্তর হলে এটি সরকারি নীতিমালার আলোকে চলবে। এখানে সহকারী প্রকৌশলী পদে যাঁরা ঢোকেন তাঁদের অনেকে দু-এক বছরের মধ্যেই দেশের বাইরে চলে যান। কেউ বিসিএস ক্যাডার হয়ে চলে যান। অধিদপ্তর হলে এখানে সুযোগ-সুবিধা বাড়বে, ফলে কাজে গতি আসবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, বোর্ড হওয়ায় এখানকার কর্মকর্তারা বিভিন্ন জায়গায় সেভাবে পাত্তা পান না। তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও কম। অধিদপ্তর হলে কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ হলে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদাও বাড়বে।
নদী বন্দর/আরএস