নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর সরাসরি আস্থা না রেখে সামগ্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলছে, বর্তমান কমিশনের অধীনে নয়, বরং ঐকমত্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব।
রোববার (২০ এপ্রিল) প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে এমন অভিমত প্রকাশ করেন। এ সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অনিক রায় (যুগ্ম আহ্বায়ক), খালেদ সাইফুল্লাহ (যুগ্ম আহ্বায়ক), মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন (যুগ্ম আহ্বায়ক) ও তাজনূভা জাবীন (যুগ্ম আহ্বায়ক)।
প্রধান উপদেষ্টার আগে রোডম্যাপ নিয়ে ইসি কথা বলায় সন্দেহ প্রকাশ করে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট আসার পরে উনারা থাকতে পারলে থাকবে; না থাকতে পারলে থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা অনেকগুলো কথা ইসি থেকে শুনতে পাই। যেগুলো আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে শুনিনি। রোডম্যাপের কথা শুনিনি, ইসি থেকে এসেছে। এজন্য আমরা বলবো— কোনো জায়গায় কথা বলার জন্য ইসি নিজেদের জায়গায় সতর্ক থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টা যে কথা বলেছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন; সে বিষয়ে কাজ শুরু করতে পারে ইসি। কিন্তু রোডম্যাপ বা সরকার থেকে কোনো দিকনির্দেশনা আসার আগেই যখন তারা নিজেদের থেকে কথা বলে থাকেন; সেজন্য আমরা সন্দেহ পোষণ করি।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ১৭ এপ্রিলের চিঠিতে সংস্কারের বিষয়গুলো ফোকাস করা হয়েছে। সংস্কারের মাধ্যমে যেন নতুন নির্বাচন আসে, ইসি যেন সেই দিকে ধাবিত হয়; জনদাবির মুখে সেটা যেন হয় তা জানিয়েছি।
মৌলিক সংস্কারসহ ইসির পুনর্গঠন চেয়েছেন- সেক্ষেত্রে বর্তমান ইসি নাকি পুনর্গঠন বা বর্তমান ইসির প্রতি আস্থা আছে কিনা? এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বরাবরই বলেছিলাম, ২০২২ এর যে আইন (সিইসি ও ইসি নিয়োগ) বিএনপিও বিরোধিতা করেছিল, সবগুলো দলই বিরোধিতা করেছিল; ফ্যাসিস্ট সরকার সে নিয়মগুলো বানিয়েছিল। এর অধীনে আসন্ন নির্বাচন না হয়ে সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশে যেন নির্বাচন হয় সে বিষয়ে বলেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপি মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলাম, ২০২২ সালের আইনে সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া আমরা ওই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করি। যাতে সংস্কারের মধ্য দিয়ে, একটা সুন্দর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেখানে যদি ঐকমত্য কমিশন সম্মত হয়, তারা যাতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। তার পরবর্তীতে যদি হয় এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আকারে সরকার, ঐকমত্য কমিশন থেকে যদি ডিসিশন আসে সে বিষয়ে ইসি পুনর্গঠন হলে আমরা দেখব। যদি না হয় তখন এ বিষয়ে মন্তব্য করব।
তিনি আরও বলেন, (সিইসি ও ইসি নিয়োগ) ২০২২ এর আইন রয়েছে আমরা পূর্বে জানিয়েছিলাম, আইনটা অবৈধ। অন্যান্য দলও জানিয়েছে অবৈধ। সে আইনের অধীনেই হয়েছে বর্তমান (ইসি)। আমরা এ আইনের বিরোধিতা করি। কিন্তু এখন যারা আছেন, তাদেরকে সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিতে হবে। ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট আসার পরে উনারা থাকতে পারলে থাকবে; না থাকতে পারলে থাকবে না। এটা ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে। কারো প্রতি কোনো অবজেনকশন নেই, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী হোক।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট যখন ফাইনাল হয়ে আসবে; তখন সরকার প্রতিটি রিপোর্ট সাংবিধানিক কমিশনে পাঠাবে। যাতে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়। আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসেছিলাম, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও বলেছি।
মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার অতি জরুরি। বর্তমানে যে প্রক্রিয়া রয়েছে, ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট আসার পরে; সিদ্ধান্তগুলো হওয়ার পরে সে অনুযায়ী যদি ইসি পরিচালিত হয় তাহলে বাংলাদেশে সুন্দর নির্বাচন হবে। অনেক বিষয়ে ইসি সম্মত হয়েছে, আইনগুলো ঐকমত্য কমিশনের হয়ে আসতে হবে।
বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আমরা তাদের জানিয়েছিলাম, সংস্কারের প্রত্যেকটি রিপোর্টের পাতা বাই পাতা, ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড, প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আগামীতে একটি নির্বাচনে যেতে হবে। সংস্কার সুপারিশের প্রতিটি লাইন অনুযায়ী নিয়ম, নীতির মধ্য দিয়ে প্রায়োগিক আকারে বাংলাদেশকে সেদিকে যাত্রা শুরু করতে হবে। সিইসি একমত হয়েছেন। ঐকমত্য কমিশনের সাথে ঐকমত্য পোষণ না করে, আমরা আস্থা পোষণ করতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন ১৫ বছরে একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে অনেক। নতুন বাংলাদেশে এটা দেখতে চাই না। স্পেসিফিক বক্তব্য পেশ করেছি। নির্বাচন কমিশন করতে হলে একটা সুন্দর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
সিইসির কাছে যে দাবিগুলো জানিয়েছে এনসিপি
নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী জানান, মনোনয়নপত্র জমা দিতে সশরীরে আসার বিধান, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইসি থেকে নির্বাচনের সার্টিফিকেশন দেওয়া, প্রার্থীদের হলফনামা তদন্ত করে তার সত্যতা নিরূপণ করা, নির্বাচনী সহিংসতা রোধে আচরণবিধি ও ব্যয়ের বিধিতে পরিবর্তন আনা, ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া বন্ধ করা, হলফনামায় ভুল তথ্য থাকলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল ও নির্বাচিত হলেও যেন তারা সংসদে থাকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য সময় বাড়ানো, রাজনৈতিক দলগুলো যেন অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
এগুলো বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচনে যাওয়া ও ভোটাধিকার প্রয়োগ সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি।
নদীবন্দর/এএস