প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) উদ্যোগী হলেও তাদের ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রমে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এক্ষেত্রে তদন্তে আটকে আছে সাত দেশের ২১ হাজার ৭২০ জন প্রবাসীর জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধন আবেদন।
রোববার (৪ মে) সাত দেশ থেকে পাঠানো প্রবাসীদের নিবন্ধন কার্যক্রমের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও মালয়েশিয়া; এই সাতটি দেশে দূতাবাসের মাধ্যমে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইসি। এক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন করে দূতাবাসে এসে ফটো তুলে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরে কার্যক্রমটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।
ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, প্রবাসীদের নিবন্ধন আবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে দেশে একটি তদন্ত করতে হয় যে ওই ভোটার আসলেই বাংলাদেশের নাগরিক কিনা। নাগরিক হলে তার নিবন্ধন আবেদনটি অনুমোদন করা হয়। আর তথ্যের মিল না পেলে তা বাতিল করা। তবে এ তদন্ত কার্যক্রম একটু ধীরগতির। কারণ একই সঙ্গে একজন উপজেলা কর্মকর্তা ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম, এনআইডি সংশোধন ও তদন্ত, অফিসের দৈনন্দিন কার্যক্রম এবং এর সঙ্গে প্রবাসীদের নিবন্ধন আবেদনের তদন্ত করা হয়। এসব কারণে একটু ধীরগতি হয়ে থাকে। তবে প্রবাসীদের আমারা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।
প্রবাসীদের ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়া তুলে ধরে ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, আমরা সাতটা দেশে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালাচ্ছি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশে আমাদের দূতাবাসের লোকবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা একটা নির্দিষ্ট ফি নিয়ে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অর্থাৎ তারা অনলাইনের তথ্যের ইনপুট দেওয়া, ছবি তোলা ও চোখের আইরিশ নেওয়ার কাজটি করে দিচ্ছে। এরপর সেই ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সেই আবেদনের সত্যতা প্রমাণে তদন্ত করছেন। তদন্তে সত্যতা মিললে সেটিকে আমরা অনুমোদন দিচ্ছি। এরপর প্রবাসীর এনআইডি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সাতটি দেশে মোট আবেদন পড়েছে এখন পর্যন্ত ৪৪ হাজার ৪৬০টি। যাচাইয়ে বাতিল হয়েছে ৩ হাজার ৫১৪টি এবং উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ২১ হাজার ৭২০ জনের আবেদন। তদন্ত শেষে আবেদন অনুমোদন হয়েছে ১৮ হাজার ৭৫৮ জনের। অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে ৪৬৮ জনের আবেদন। আর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আঙুলের ছাপ ও ছবি নেওয়া হয়েছে ২৭ হাজার ৯৫৩ জনের। সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৯ হাজার সাতটি। আর সবচেয়ে কম আবেদন পড়েছে মালয়েশিয়ায় ৯৩৯ জন। গত বছরের মে থেকে এই আবেদনগুলো এসেছে।
নির্বাচন কমিশন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি-বায়রাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে। এইসব দেশকেই মাথায় রেখে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দেশগুলো হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মৌরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাস। এসব দেশে এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন প্রবাসী রয়েছে। সবচেয়ে রয়েছে বেশি প্রবাসী রয়েছে সৌদি আরবে ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ জন। আর সবচেয়ে কম রয়েছে নিউজিল্যান্ডে ২৫০০ জন।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন ওই ৪০টি দেশেই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে তা হাতে নিতে হচ্ছে। তবে যেসব দেশে কার্যক্রম চলমান, সেখান থেকেও খুব একটা সাড়া মিলছে না।
এদিকে গত মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) প্রবাসীদের ভোট দান পদ্ধতি নির্ধারণে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষকদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যেখানে প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও দলগুলো বলছে, ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও জনগণের আস্থার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ওই সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা আমাদের ওয়াদা। সবার দাবিও এটা আমাদের কাছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করেছি। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও শিক্ষা সবকিছু পর্যালোচনা করে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমর্থন না দিলে কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পেয়ে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৯ সালে প্রবাসে এনআইডি সরবরাহের উদ্যোগ হাতে নেয়। এরপর ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যে প্রবাসীদের অনলাইনে ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করে ইসি। এর আগে ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীদের মাঝে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। তার আগে একই বছর ৫ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অংশ হিসেবে অনলাইনে আবেদন নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এরপর সৌদি আবর, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে থাকা বাংলাদেশিদের জন্যেও এ সুযোগ চালু করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে থমকে যায় দূতাবাসের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই কার্যক্রমকে ফের উজ্জীবিত করেন। এক্ষেত্রে আগের আবেদনগুলো পাশ কাটিয়ে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করেন তারা। সেই কার্যক্রমকেই এগিয়ে নিচ্ছে বর্তমান নাসির কমিশন।
নদীবন্দর/ইপিটি