সচিবালয়ে কর্মচারীদের আন্দোলনের মধ্যেই সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যায় এ অধ্যাদেশ জারি করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
অধ্যাদেশের ফলে, সরকারি কর্মচারীদের চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধুমাত্র কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে সরকার।
তার আগে গত ২২ মে অধ্যাদেশের খসড়ার অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে রোববার সচিবালয়ের কর্মচারীরা তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে। সচিবালয়ের ভেতর বিক্ষোভ করেছেন ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা। সচিবালয়ের বাইরে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এদিকে অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ।
আন্দোলনরতরা বলছেন, এই অধ্যাদেশের ফলে সহজেই সরকার তাদেরকে চাকরিচ্যুত করতে পারবে। বিষয়টিকে নিজেদের চাকরির নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছে তারা। উল্লেখ্য, বেসামরিক প্রশাসনে বর্তমানে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৮ জন কর্মরত আছেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পদক্ষেপ সরকারি কর্মচারীদের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং সংবিধানের এটি সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ৷
সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯-এর চারটি ধারা নতুন অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো:
১. এমন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, যার কারণে অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে
২. অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া, নিজ কর্ম হতে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন
৩. অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম হতে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার নিমিত্তে উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন
৪. যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন
নতুন অধ্যাদেশে এসব কর্মকাণ্ডের দায়ে সরকারি কর্মচারীদের নানা ধরনের শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্তের দণ্ড দেওয়া। বিভাগীয় মামলা না দিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হবে ৷
উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানটি ২০১৮ সালে বিলুপ্ত করা হয়েছিল।
রোববার সন্ধ্যায় অধ্যাদেশ জারির পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ।
পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেন, ‘সোমবার সকাল ১১টায় সচিবালয়ে আমাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে। সেখান থেকে আমরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবো।
তার আগে দিনভর অধ্যাদেশের জারির বিষয়ে সরকারের উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছে সচিবারয়ের কর্মচারীরা। সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সামনের জড়ো হন কর্মচারীরা। এরপর সচিবালয়ের ভেতর বিক্ষোভ করেন তারা।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম এবং সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেক অংশের সভাপতি বাদিউল কবীরের নেতৃত্বে কয়েকশ কর্মচারী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হন।
সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের দপ্তর ঘেরাও করেন তারা। উপদেষ্টা সেসময় দপ্তরে না থাকায় সেখানে ১৫-২০ মিনিট অবস্থান করে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে সেখানে অবস্থান নেন কর্মচারীরা। এ সময় আধা ঘণ্টা সচিবালয়ে কোনো গাড়ি প্রবেশ ও বের হতে পারেনি।
গণপূর্ত উপদেষ্টার দপ্তর ঘেরাওয়ের সময় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব সচিব মো. নজরুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করছিলেন। কর্মচারীরা উপদেষ্টার দপ্তর ঘেরাও করায় তিনি সভাকক্ষে থেকে বেরিয়ে এসে কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় কয়েকজনকে নজরুল ইসলামের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়াতে দেখা যায়।
সমাবেশে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে নতুন অধ্যাদেশ করা হচ্ছে। এধরনেরনিবর্তনমূলক আইন আমরা মানব না। উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হওয়া অধ্যাদেশের খসড়া সম্পূর্ণ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।
যা বলছেন বিশ্লেষকেরা?
রোববার অনুষ্ঠিত হওয়া কর্মচারীদের প্রতিবাদকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান। তিনি বলেন, মাথা ব্যথা হলে তো ওষুধ খাবেন, মাথা তো কেটে ফেলবেন না।
সাবেক এই আমলা বলেন, সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবেন সে বিষয়ে তো আমাদের অনেক আইন আছে। সেসবের আলোকেই তো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়৷ ১৯৭৯ সালের একটি অধ্যাদেশ রহিত হলেও এখন সেটিকে কার্যকর করা অনুচিত। এই সরকারের অঙ্গীকার হলো গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা। যেসব আইনে মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় সেগুলো বাতিল করবে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, আগের অধ্যাদেশ ৪০ বছর চালু ছিল। বাস্তবতা হলো নিরীহ কিছু কর্মচারীর চাকরি যাওয়া ছাড়া কোনো দলবাজ নেতা এবং রাজনৈতিক সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কোনো নেতা বা কর্মচারীরা চাকরি যায়নি। এটা নিয়ে সাধারণ ও নিরীহ কর্মচারীদের মধ্যে ভয় এটা তাদের ওপর প্রয়োগ হবে। এ জন্য তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভীত ও সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
নদীবন্দর/জেএস