গুম মানে শুধু নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নয়—এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব নির্মমতা। দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুম তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, গুমের পর অনেককে হত্যা করা হয়েছে ইনজেকশন পুশ করে। কারও মরদেহ ফেলা হয়েছে নদীতে, আবার কাউকে ট্রেন বা গাড়ির নিচে ফেলে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে সাজানো হয়েছে। এমনকি ইটভাটায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মরদেহ—তথ্যগুলো প্রকাশ্যে এনে কমিশনের প্রতিবেদন দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে।
প্রতিবেদনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে উঠে এসেছে, গুম নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরেই বিরোধ ও অস্বস্তি ছিল। অনেক সদস্য এসব ঘটনায় অংশ নিতে চাননি। কেউ কেউ নির্যাতিত পরিবারকে সাহায্যও করেছিলেন। কিন্তু এর ফল হয়েছে ভয়াবহ। জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, গুমে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানো কর্মকর্তারা পরে রোষানলে পড়েছেন। কেউ কেউ হয়েছেন বদলির শিকার, আবার অনেকে পদোন্নতির লোভে বা চাপে পড়ে সাজিয়েছেন ‘জঙ্গি নাটক’।
গুম কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তারা এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু তারা নিরুপায় ছিলেন। তাদের বাধ্য করা হয়েছে। কারণ, এটা শুধু তাদের চাকরির প্রশ্ন ছিল না, জীবনের ও পরিবারের নিরাপত্তার প্রশ্নও ছিল।
তদন্তে জানা গেছে, শুধু গুলি করে হত্যা নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত ও কৌশলগত নানা উপায়ে গুমের শিকারদের হত্যা করা হয়েছে। যেমন— ইনজেকশন পুশ করে চুপিচুপি হত্যা করা হয়েছে কিছু গুম ভিকটিমকে; নদীতে ফেলে মরদেহ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে; ইটভাটায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে লাশ—যাতে শনাক্ত করার সুযোগ না থাকে এবং ট্রেন বা গাড়ির নিচে ফেলে সাজানো হয়েছে দুর্ঘটনার নাটক।
কমিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। এমন ভয়ঙ্কর অপরাধের বিস্তারিত প্রকাশ হওয়ায় আমরা সত্যের কিছুটা হলেও নাগাল পাচ্ছি। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। তাদের আরও গভীরে গিয়ে কাজ করতে হবে। এমন কাজ যেন আর কখনও না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ধরনের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক স্তরের সদস্য জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়িত হয়েছে। তিন স্তরে ভাগ করা হয়েছে এই কাঠামো: প্রথম স্তরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—যারা গুমের পরিকল্পনা ও অনুমোদনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। দ্বিতীয় স্তরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা, যারা গুম কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। আর তৃতীয় স্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মাঠপর্যায়ের সদস্য ও কর্মকর্তারা, যারা সরাসরি অপারেশনে অংশ নিয়েছেন।
কমিশনের মতে, অনেক পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের মধ্যেই এই ঘটনার প্রতি অসন্তুষ্টি ছিল। কিন্তু ভয়, চাপ এবং প্রতিশোধের আশঙ্কায় কেউ কথা বলার সাহস পাননি। একদিকে চাকরি হারানোর ভয়, অন্যদিকে পরিবার নিয়ে শঙ্কা—এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে তারা মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। পুরনো কাঠামো এখনো কার্যকর রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এখনও একইভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিদ্যমান, যা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আমিনুল করিম বলেন, কমিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। এমন ভয়ঙ্কর অপরাধের বিস্তারিত প্রকাশ হওয়ায় আমরা সত্যের কিছুটা হলেও নাগাল পাচ্ছি। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। তাদের আরও গভীরে গিয়ে কাজ করতে হবে। এমন কাজ যেন আর কখনও না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
নদীবন্দর/জেএস