আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন একটি বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছে। কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— অপারেশনের পর র্যাবের এক কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জানান, তিনি ‘অপারেশনের’ পর প্রাপ্ত টাকা গ্রামের মসজিদে দান করেছিলেন।
এই কমিশন গঠন করা হয় গত ২৭ আগস্ট। পাঁচ সদস্যের এই কমিশন ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সংঘটিত গুমের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত তারা গুম সংক্রান্ত ১,৮০০টি অভিযোগ পেয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, এসব গুম ছিল প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো ব্যক্তিগত অসদাচরণের চেয়েও বড় ‘পদ্ধতিগত সমস্যা’র ফলাফল।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে এমন একটি চর্চা ছিল, যেখানে গুম বা হত্যার মতো অপরাধ করেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। বরং এসব ঘটনা নীরবে প্রশ্রয় পেত।
কমিশন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার থেকে প্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুমের সাতটি নথি পর্যালোচনা করেছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এসব ঘটনা কোনো একক ব্যক্তির কাজ ছিল না। বরং একাধিক ইউনিটের একাধিক সদস্য এতে জড়িত ছিলেন।
একটি উদাহরণে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী থেকে র্যাবে প্রেষণে আসা এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুমে জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। অথচ তৎকালীন র্যাব ডিজি বেনজীর আহমেদ তাকে ‘অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা’ হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন।
কমিশনের কাছে র্যাবের এক জ্যেষ্ঠ জেনারেল স্বীকার করেছেন, তিনি সেনা কর্মকর্তাদের এমন কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। তাদের ব্রিফিং ও ডিব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন যেন নিরস্ত্র মানুষদের বেআইনিভাবে হত্যা না করা হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনে এক ঘটনায় দেখা যায়, র্যাব থেকে ইউনিটে ফিরে আসা এক জুনিয়র কর্মকর্তাকে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করেন— তিনি কাউকে হত্যা করেছেন কিনা। শুরুতে ওই কর্মকর্তা দ্বিধা করেন। পরে স্বীকার করেন, তিনি নিজ হাতে দুজনকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারজনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন।
ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা এরপর জানতে চান, অপারেশনের পর যে টাকা পেয়েছিলেন, তিনি তার কী করেছেন। উত্তরে ওই জুনিয়র কর্মকর্তা জানান, তিনি তা গ্রামের মসজিদে দান করে দিয়েছেন।
কমিশন বলছে, এটি শুধু সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পুলিশের উপ-পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, তারা ঊর্ধ্বতনদের তৈরি করা নথিতে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করতে বাধ্য হতেন। এভাবে তারাও গোপনে এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়তেন। অথচ এই অবৈধ নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তাদের ছিল না।
কমিশনের এই প্রতিবেদন এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে— যেখানে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি ‘ব্যবস্থাগত বাস্তবতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
নদীবন্দর/জেএস