ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ রোববার (৩ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। বিচারকার্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ সকাল সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হয় এবং আদালতের অনুমতিক্রমে সেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। এই মামলাটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও সংবেদনশীল বলে বিবেচিত হচ্ছে।
মামলার আসামির তালিকায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি রয়েছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মামলার আরেক গুরুত্বপূর্ণ আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ইতিমধ্যেই মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজের দায় স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাষ্ট্রপক্ষের স্বীকৃত সাক্ষী হিসেবে আদালতে সহযোগিতা করছেন।
মামলায় মোট পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ অপর দুই আসামির বিরুদ্ধে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানো, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে পরিকল্পিত হামলা পরিচালনা, গুলি ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার মতো অপরাধ।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘নাতিপুতি’ বলে আখ্যা দিয়ে একটি উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর সদস্যরা রাজধানীসহ সারাদেশে সংগঠিত ও সহিংস আক্রমণ চালায়। এতে প্রায় দেড় হাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ নিহত এবং প্রায় ২৫ হাজার আহত হন বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা আন্দোলন দমন করতে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তার এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন। আদালতে উপস্থাপিত অডিও রেকর্ড অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আলাপে এই নির্দেশনা দেন, যা পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
তৃতীয় অভিযোগে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার জন্য এই তিন আসামিকে দায়ী করা হয়েছে। চতুর্থ অভিযোগে রয়েছে, রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছয়জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, আশুলিয়ায় ছয়জন নিরস্ত্র মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, যার পরিকল্পনা ও অনুমোদনে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
সব অভিযোগে আসামিদের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ বা শীর্ষ পর্যায়ের দায়ভার বহনের আওতায় বিচার করা হচ্ছে। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযুক্তরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকে এই অপরাধগুলোর অনুমোদন দিয়েছেন কিংবা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছেন।
এটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া চতুর্থ মামলা। এর আগে, ২ জুলাই আদালত অবমাননার দায়ে ট্রাইব্যুনাল তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর এটিই তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম খালাস-বহির্ভূত বিচারিক কার্যক্রম।
এছাড়া, শেখ হাসিনাসহ আরও ১১ জনের বিরুদ্ধে গুম, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ২৪ আগস্ট। একইভাবে, হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর ২০১৩ সাল ও পরবর্তী সময়ের দমনপীড়নের ঘটনায় করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত আছে ১২ আগস্ট।
নদীবন্দর/জেএস