গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক এক হামলায় পাঁচ সাংবাদিকসহ অন্তত ২১ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। গাজার দক্ষিণে অবস্থিত নাসের হাসপাতালের ভেতরে ঘটনাটি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে চিকিৎসক, উদ্ধারকর্মী এবং সাধারণ রোগীরাও রয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, হাসপাতালকে সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, ইসরায়েল বারবার এই ধরনের স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে একটি ভবনের ওপরের তলায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। এরপর কিছু সময়ের ব্যবধানে যখন সাংবাদিক ও উদ্ধারকর্মীরা আহতদের সাহায্য করতে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করছিলেন, তখন দ্বিতীয় দফায় আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এই পরিকল্পিত হামলাকে ‘ডাবল ট্র্যাপ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন নাসের হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা।
এই হামলায় নিহত পাঁচ সাংবাদিক হলেন—আল জাজিরার মোহাম্মদ সালাম, রয়টার্সের ক্যামেরাপারসন হুসাম আল-মাসরি, এপির হয়ে কাজ করা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মরিয়ম আবু দাক্কা, আহমেদ আবু আজিজ এবং মুয়াজ আবু তাহা।
হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আল জাজিরা একে ‘সত্য ধ্বংসের স্পষ্ট প্রয়াস’ বলে উল্লেখ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সাংবাদিক তারেক আবু আযম বলেন, এই হামলা পুরো এলাকাকে আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুতে ঢেকে দিয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীরাও।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলে আখ্যা দিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটা কেবল সাংবাদিকদের ওপর হামলা নয়, বরং সত্য, তথ্য এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর সরাসরি আঘাত।
এই ঘটনায় ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যও দ্রুত ও স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দপ্তর একে ‘দুর্ভাগ্যজনক ভুল’ বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। অতীতেও ইসরায়েল একই ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, কিন্তু কখনো দায় স্বীকার করেনি বা কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।
এছাড়া একই দিন খান ইউনিসে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে আরেক সাংবাদিক হাসান দোউহান নিহত হন। ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সংগঠন একে ‘মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে মন্তব্য করেছে।
এদিকে গাজা শহরজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সোমবার ভোর থেকে পরিচালিত হামলায় আরও অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সাতজন নিহত হন খাদ্য সহায়তা নিতে এসে। আল-আউদা হাসপাতাল জানায়, খাদ্য সংগ্রহে আসা ছয়জনকে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে, আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন।
গাজার সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, শুধু ৬ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত গাজা শহরে এক হাজারের বেশি ভবন ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছেন, কিন্তু টানা গোলাবর্ষণ ও রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সাহায্যবাহী কনভয় বা বিতরণকেন্দ্রে খাদ্য নিতে গিয়ে অন্তত ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
একই সঙ্গে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা দপ্তর সতর্ক করে বলেছে, গাজায় শিশুরা চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে দক্ষিণ গাজায়। অক্সফামের মানবিক সহায়তা পরামর্শক ক্রিস ম্যাকইন্টশ একে ‘মানবতার ইতিহাসে নজিরবিহীন বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, গাজার যুদ্ধ দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। যদিও এর আগেও তিনি এ ধরনের দাবি করেছেন, যা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। সমালোচকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থনই ইসরায়েলকে দায়মুক্তির সুযোগ দিচ্ছে।
নদীবন্দর/এএস