লঞ্চের মেঝেতে পড়ে আছেন অসুস্থ ষাট বছরের এক বৃদ্ধা। পাশে বিমর্ষমুখে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিশ বছরের এক যুবক। বৃদ্ধার মাথার পাশে একই বয়সের এক নারীকে বসে থাকতে দেখা যায়। সবাই বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে কখন জোয়ার আসবে। পাশে গিয়ে প্রশ্ন করলে যুবক সাখাওয়াত হোসেন জানায় অসুস্থ বাবাকে নিয়ে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। ভোরে তাদেরকে বহনকারী ঢাকা থেকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা লঞ্চটি ডুবোচরে আটকা পড়লে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সকাল ১১টার দিকে জোয়ার আসলে তারা ঘাটে যেতে পারবে। একদিকে অসুস্থ বাবার আহাজারি অন্যদিকে লঞ্চের মধ্যে খাওয়ার দোকান বন্ধ থাকায় সঙ্গে থাকা বোনের দুই শিশু সন্তান নিয়ে খুবই খারাপ সময় পার করতে হচ্ছে তাদের।
সাখাওয়াত হোসেনের বাড়ি নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বুডিরচর ইউনিয়নের রেহানিয়া গ্রামে। সাখাওয়াত হোসেনের মতো এই সমস্যা প্রতিদিন মোকাবেলা করতে হচ্ছে ঢাকা-হাতিয়া রুটে চলাচলকারী হাজার হাজার যাত্রী সাধারণের। গত ছয় মাস ধরে প্রতিদিন ঢাকা থেকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বড় তিনতলাবিশিষ্ট লঞ্চগুলো নাব্য সংকটের কারণে ডুবোচরে আটকা পড়ছে।
এই ডুবোচরগুলোর অবস্থান মূলত ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার পূর্ব পাশে, নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার উপজেলার তমরদ্দি ঘাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে বধনার চরের সন্নিকটে মেঘনা নদীতে। এই ডুবোচরের কারণে সকল ধরনের লঞ্চ চলাচল প্রায়ই ব্যহত হয়। প্রায়ই লঞ্চ আটকে যায় চরে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা। অনেক সময় ব্যবসায়ীদের কাঁচামাল চরে আটকে পড়া লঞ্চেই নষ্ট হয়ে যায়। ডুবো চরে আটকা পড়লে দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না।
সরেজমিনে ডুবোচরে আটকে যাওয়া অবস্থায় এমভি তাসরিফ-১ লঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, লঞ্চের নিচতলায় ইঞ্জিন রুমের পাশে ৮-১০ বছর বয়সের এক বাচ্ছাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চাশার্ধ্বো এক মহিলা। আলাপকালে কোহিনুর আক্তার নামে এক মহিলা জানায়, ঢাকার মিরপুরের বসবাস করেন তিনি। সে এসেছে হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের মাইজচরা গ্রামে বাবার বাড়িতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠান তখন সময় ১০টা কিন্তু কখন বাড়ি পৌঁছবে তার সঠিক সময় জানা নেই তার। রাতে লঞ্চে খাওয়ার ব্যবস্থা হলেও লঞ্চ আটকে যাওয়ায় সকালে লঞ্চের দোকানিরা দোকান বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। তাই চাইলে ও কেউ কোনও কিছু কিনতে পারছে না। খাওয়ার নিয়ে কষ্ট করতে হচ্ছে তাদেরকে। এতে তিনিসহ সঙ্গে শিশু থাকা অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। ছোট ছোট ট্রলারে অনেক যাত্রীকে তীরে যেতে দেখেছেন তিনি কিন্তু সঙ্গে শিশু থাকায় তিনি যেতে সাহস করেননি।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া মূলত নদীবেষ্টিত এখানে প্রায় সাত লাখ লোকের বসবাস। এ উপজেলার মানুষের চলাচলে নদী পথই একমাত্র ভরসা। এর মধ্যে ঢাকা-হাতিয়া রুট, হাতিয়া -চট্টগ্রাম রুট ও হাতিয়ার নলচিরা-চেয়ারম্যান ঘাট রুটে যাত্রী পারাপার হয় কিছু সরকারি ও কিছু বেসরকারি যানবাহনে।
এর মধ্যে ১৯৯৭ সাল থেকে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি লঞ্চ সার্ভিস চালু করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দিকে একটি প্রতিষ্ঠান এই দুটি লঞ্চ দিয়ে যাত্রীসেবা দিলে গেলো তিন বছর আগ থেকে এই রুটে আরও একটি প্রতিষ্ঠান তাদের লঞ্চ সার্ভিস চালু করে। প্রতিদিন হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাট থেকে দুটি লঞ্চ দুপুর একটার সময় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আবার প্রতিদিন বিকেল ছয়টার সময় ঢাকার সদরঘাট থেকে দুটি লঞ্চ হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে।
হাতিয়া থেকে যে কয়েকটি নৌ রুটে যাত্রী পারাপার হয় এর মধ্যে ঢাকা-হাতিয়া রুটটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই রুটে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন সহস্রাধিক যাত্রী আসা- যাওয়া করে।
এছাড়া মাছ, চাল, আলু হাতিয়ায় উৎপাদিত খেসারি ডাল, বাদামসহ প্রচুর মালামাল আনা নেওয়া করে ব্যবসায়ীরা। এই কারণে ঘাটের পাশে তমরদ্দি বাজার হয়ে উঠেছে মুদি মালের বিশাল আড়ৎ ব্যবসা কেন্দ্র।
আলাপকালে তমরদ্দি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি ইব্রাহীম (৬০) জানান, ঢাকা থেকে হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাটে আসা লঞ্চের কারণে এখন তমরদ্দি বাজার বিশাল পাইকারি বাজারে পরিণত হয়েছে। এখানে ছোট বড় প্রায় ৫০টি আড়ত রয়েছে। যা থেকে হাতিয়ার বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীরা মালামাল ক্রয় করে থাকে। নাব্য সংকটের সঠিক সময়ে লঞ্চ ঘাটে না আসায় এই বিশাল ব্যবসা কেন্দ্র একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে।
হাতিয়া- ঢাকা রুটে চলাচলকারী এমভি ফারহান-৩ এর মাস্টার বজলুর রহমান জানান, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এই জায়গায় বিআইডব্লিউটিএর লোকজন নদীতে ড্রেজিং করতে আমরা দেখেছি। কিন্তু কিছুদিন ড্রেজিং করে তারা চলে যায়। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সমন্বয় ছিল না। তারা তাদের মতো করে ড্রেজিং করে চলে যায়। এর সুফল আমরা পেয়েছি মাত্র একমাস এর পরে আবার নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে।
তমরদ্দি ঘাট ইজারাদার প্রতিনিধি আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, লঞ্চ চলাচলের এই পথে অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে। ভাটির সময় কোনও কোনও চর জেগে ওঠে। জোয়ারে তলিয়ে যায়। আর এই চরেই আটকা পড়ে লঞ্চ। এতে রাতের বেলা বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে লঞ্চ চলাচল শতভাগ নিরাপদ করার দাবি তার।
এ বিষয়ে আলাপকালে বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম জানান, এই ডুবোচরটি নিয়ে আমরা একটি সার্ভে করেছি। তাতে দেখা যায় আমাদের সবচেয়ে বড় ড্রেজিং ইঞ্জিনটি ব্যবহার করতে হবে এখানে। সে মোতাবেক এটি পাটানো হয়েছে হাতিয়াতে। কিন্তু এর আগে দ্বীপের কাছাকাছি একটি ছোট ড্রেজিং করতে গিয়ে এর ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। আসছে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে তা মেরামত করা যাচ্ছে না তাই এই বছর এই ড্রেজিং করা মনে হয় সম্ভব হবে না।
নদী বন্দর / এমকে