২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায় ঘোষণা করা হবে আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর)।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সকাল ১১টায় রায় ঘোষণার জন্য বসবেন। রায়কে ঘিরে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থানেও সতর্ক অবস্থানে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রায় ঘোষণার আগের রাত থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। সোমবার ভোর থেকে ট্রাইব্যুনালের চারপাশে অতিরিক্ত সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালের সব প্রবেশপথে অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সন্দেহ হলে তল্লাশি করা হচ্ছে পথচারী, গাড়ি এবং বহন করা ব্যাগ।
পুলিশ জানায়, রায়কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা বা নাশকতার চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।
গত ১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর তারিখ নির্ধারণ করে ট্রাইব্যুনাল। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন। মামলায় আসামির সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছেন প্রসিকিউশন। আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক।
এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস. এইচ. তামিম শুনানি করেন। এছাড়া, প্রসিকিউটর বি. এম. সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, পলাতক দুই আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
ঐতিহাসিক এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাবাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। মোট সাক্ষী ছিলেন ৫৪ জন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠনের পর প্রথম মামলা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা গঠন করা হয়।
গত বছরের ১৭ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও বিচারকাজ শুরু হয়। পরে এ বছরের মার্চে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাবেক আইজিপিকে মামলায় আসামি করতে প্রসিকিউশনের আবেদন মঞ্জুর করে ট্রাইব্যুনাল।
মামলায় পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় গত ১২ মে। ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগনামায় রয়েছে ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার তথ্যসূত্র, ৪ হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণ, এবং শহীদদের তালিকার ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার বিবরণ।
এর ভিত্তিতে ১ জুন হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল ও আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ১০ জুলাই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।
এক পর্যায়ে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করলে তা মঞ্জুর করে ট্রাইব্যুনাল। পরে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দেন।
গত ২৩ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সমাপনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করেন। পরে চিফ প্রসিকিউটরও একই আবেদন জানান। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তিন আসামির খালাস চান।
অভিযোগসমূহ
প্রথম অভিযোগ: গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর প্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচণা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয় অভিযোগ: হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ চলে যায়। এর আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগ: রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়।
চতুর্থ অভিযোগ: রাজধানীর চাঁনখারপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগ: আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে হত্যার আগুনে পোড়ানোর ঘটনায়ও অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন।
সরাসরি রায় দেখবে সারা বিশ্ব
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় দেখতে পারবে সারা বিশ্ব। এর রায় ঘোষণা সরসারি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বিটিভি, রয়টার্স এবং ট্রাইব্যুনালের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ। পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে বড় স্ক্রিনে লাইভ সম্প্রচারের আয়োজন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
আওয়ামী লীগের শাটডাউন ও পরিবহন পরিস্থিতি
রায়ের দিন দেশব্যাপী শাটডাউনের ঘোষণা দিয়েছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। তবে পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন জানিয়েছে, সাধারণ মানুষের চলাচল স্বাভাবিক রাখতে গণপরিবহন চলবে।
নদীবন্দর/জেএস