কুমিল্লার প্রাচীন ঐতিহ্য ‘কান্দিখাল’। বৃটিশ আমলে শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে জেলার সদর দক্ষিণের ডাকাতিয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এ খালে চলাচল করত পাল তোলা নৌকা। ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক পণ্য নৌকায় করে শহরে আনা-নেওয়া হতো। শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রধান মাধ্যমও এ খাল। তবে কোনো কোনো স্থানে খালের অংশ দখল করে বহুতল ভবন ও দোকানপাট নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে দিনে দিনে দখল-দূষণে এ খালের চিত্র একদম পালটে গেছে। এ খাল এখন সরু ড্রেন যেন বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। মশা ও কীটপতঙ্গের উপদ্রব, ময়লা-আবর্জনা আর পচা পানির উত্কট গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে খালটি।
কুসিক সূত্রে জানা যায়, কান্দিখাল নগরীর উত্তর চর্থা নওয়াববাড়ি চৌমুহনী থেকে নোয়াগাঁও চৌমুহনী হয়ে জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার পুরাতন ডাকাতিয়া নদীতে মিশেছে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ খালের সিএস নকশা অনুযায়ী কোনো কোনো স্থানে এর প্রস্থ ৪৫ ফুট থেকে ৯৫ ফুট পর্যন্ত। এছাড়া নগরীর মনোহরপুর থেকে কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় পর্যন্ত এ খালের শাখা রয়েছে। কিন্তু দখলদারদের কবলে পড়ে এ কান্দিখালটি দিনে দিনে অনেকটা বিলীন হয়ে প্রায় ৮ ফুট থেকে ২৫ ফুট প্রস্থের ড্রেনে পরিণত হয়েছে। নগরীর দক্ষিণ চর্থা এলাকায় খাল ও সড়কের অংশে মার্কেট নির্মাণ করেছে খোদ সিটি কর্তৃপক্ষ। সেখানে খালের প্রস্থ বিলীন হয়ে বর্তমানে আছে ১০-১৫ ফুট।
এছাড়া নগরীর টমছম ব্রিজ মোড়ে ৭৯ ফুট ও নোয়াগাঁও মোড়ে ৯৫ ফুটের খালের প্রস্থ নেমে এসেছে ১৫-২০ ফুটে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এ খালের অংশবিশেষ গিলে ফেলেছে খালের পাড়ের অধিকাংশ বাসিন্দা এবং গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। সড়ক পথসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলেও আছে এ খাল। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও ভবনের সম্মুখে সংশ্লিষ্টরা যাতায়াতের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে খালের ওপর অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করেছে ব্রিজ ও কালভার্ট। এ খালের অধিকাংশ স্থানে ময়লা-আবর্জনা জমে ভরাট হয়ে আছে। খালের পাশে সওজ, পাউবো কার্যালয় ও তাদের বাণিজ্যিক দ্বিতল ভবন, বন বিভাগসহ সরকারি বেশ কয়েকটি দপ্তর, শিক্ষা-ধর্মীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দুই ডজনের অধিক প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরসহ ভাসমান দোকানপাট রয়েছে।
নগরীর উত্তর চর্থার অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মফিজুল ইসলাম (৬৫) ও কয়েক জন সিনিয়র সিটিজেন বলেন, ‘শিশুকালে সুপরিসরের এ খালে পাল তোলা নৌকা চলতে এবং উত্সবমুখর পরিবেশে জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখেছি। কিন্তু সে সময়ে দেখা এ খালের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দখল আর দূষণে এখন এ খাল অনেক স্থানে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। আশ্রাফপুর এলাকার বাসিন্দা আবুল বাসার বলেন, ‘খালের ময়লা-আবর্জনা পচে বাতাসের সঙ্গে মিশে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হচ্ছে না। এতে পচা পানি ও আবর্জনা পাশের ব্যস্ত সড়কে উপচে পড়ে উত্কট গন্ধ ছড়াচ্ছে।’ দক্ষিণ চর্থার আবুল হাসেম খন্দকার বলেন, ‘নগরীর সৌন্দর্যবর্ধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে সিটি করপোরেশন কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করলেও নগরীর পানি নিষ্কাশনের গুরুত্বপূর্ণ এ খালটি দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনায় অনেকটা ভরাট হয়ে আছে।’ কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল বলেন, ‘নগরীর পানিপ্রবাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম কান্দিখাল দীর্ঘদিনের দখলবাজিতে সংকীর্ণ ড্রেনে পরিণত হয়েছে।’ কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. নুরুল করীম বলেন, ‘কান্দিখালটির অন্তত ৭০ শতাংশ আবর্জনায় পূর্ণ। আশা করি, খালটি পরিষ্কারে সিটি কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবেন।’
কুসিক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়ক প্রশস্তের কাজ করতে গিয়ে খালের কিছু অংশ ব্যবহার করছে। এতে নগরীর পানি প্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে এবং ময়লা জমে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে। প্রতি বছর বর্ষার আগে আমরা কান্দিখাল খননসহ নগরীর সব ড্রেন পরিষ্কার করি। শিগগির এ কাজ শুরু করা হবে। এ খালের অংশ কারো দখলে থাকলে নকশা দেখে তাও উদ্ধার করা হবে।’
নদী বন্দর / এমকে