প্রায় ৬০ শতক জমির ওপর সাত-আটটি বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠে বিষ্ণুপুর নামের একটি গ্রাম। এলাকার মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় বলেন বেষ্টপুর নামে। স্বাধীনতার পর থেকেই গ্রামটি ছোট। কিন্তু লোকসংখ্যা আর বসতি কমতে কমতে এখন একটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। যাতে সদস্য সংখ্যা রয়েছে ৩২ জন।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার রুপাপাত ইউনিয়নে এই ছোট্ট গ্রামের অবস্থান। গ্রামের ওই বাড়িটিতে মোট ৯টি পরিবার বসবাস করলেও মূলত বলা চলে তারা দুটি পরিবার। গ্রামের সবাই কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল।
এ গ্রামের ভোটার সংখ্যা আগে ছিল ১৩ জন। দুজন নতুন ভোটার হয়ে এখন এর সংখ্যা ১৫ জনে দাঁড়িয়েছে। বোয়ালমারী উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী গ্রাম এটি। এর দক্ষিণ দিকে কাশিয়ানী উপজেলার মহেশপুর ইউনিয়নের জয়নগর এবং উত্তরে বোয়ালমারীর টোংরাইল গ্রাম।
গ্রামটিতে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বোয়ালমারী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০/১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রুপাপাত ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত বিষ্ণুপুর গ্রাম। কাগজপত্রে মৌজার নামও বিষ্ণুপুর লেখা। এর আশপাশের গ্রামগুলো হলো- টোংরাইল, সুতালীয়া, বনমালীপুর, কদমী।
বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা ও গ্রামের প্রধান হিসেবে পরিচিত সলেমান মোল্লা (৬৪) বলেন, ‘আমার বাবা মৃত আ. সালাম মোল্লা ও চাচা মৃত মান্নান মোল্লা দুই ভাই ছিলেন। তাদের উত্তরসূরি হিসেবে আমরা ও আমাদের ছেলে-মেয়ে নাতি-পুতি মিলে মোট ৯টি পরিবার। মোট সদস্য সংখ্যা ৩২ জন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নানা বঞ্চনা, দুর্ভোগ ও দুর্গতি এবং রাস্তা-ঘাট না থাকায় পূর্বের বসবাসকৃতরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। আমরা একটা পরিবার কোনোমতে গ্রামটি টিকিয়ে রাখছি।’
অভিযোগ করে সলেমান বলেন, ‘এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বাররা আসেন শুধু ভোটের সময়। ভোট চলে গেলে আর তাদের চেহারা দেখা যায় না। তবে ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান সাহেব বিদ্যুৎ লাইন করে দিয়েছেন। এজন্য একটু ভালো আছি। বিদ্যুতের জন্য টেলিভিশন চলে। মোবাইল চালানো যায়। তাই মনে হয় আধুনিক যুগে বাস করছি।’
ওই গ্রামের অন্য বাসিন্দা হেমায়েত মোল্লা, সাইফুল মোল্লা বলেন, আমাদের প্রয়োজন যাতায়াতের রাস্তা আর ছোট একটা খালের ওপর একটি ব্রিজ। দেড় কিলোমিটার দূরে মাগুরা সরকারি প্রাইমারি স্কুল, দুই কিলোমিটার দূরে নড়াইল হাইস্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। গ্রামে নেই কোনো মসজিদ। আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রতি বছর দুই ঈদের নামাজ পড়তে হয়।
গ্রামটি ছোট্ট হওয়ার কারণে উন্নয়ন বঞ্চিত এবং অবহেলিত রয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ওই গ্রামের বাচ্চু মোল্লা, লুৎফর মোল্লা, রোকেয়া বেগম।
গ্রামটির পার্শ্ববর্তী উত্তরদিকে টোংরাইল গ্রামের বাসিন্দা, মিরাজ মৃধা, নিখিল বিশ্বাস, মহানন্দ বিশ্বাস, পিংকু বিশ্বাস, কপিল বিশ্বাসসহ অনেকেই বলেন, বেষ্টপুর গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই খারাপ। যাতায়াতের জন্য নেই কোনো রাস্তা। ছোট একটি আইল দিয়েই চলাচল করেন তারা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই গ্রামের লোকজনের নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়ার কায়দা নেই। শুকনো মৌসুমেও তাদের কাদা অথবা শুকনো মাটি মাড়িয়ে চলতে হয়। ফলে গ্রামের বাসিন্দাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ জন্য গ্রামটির লোকসংখ্যা কমে গেছে। এভাবে চললে হয়তো গ্রামটি কাগজ কলমে নাম থাকলেও বাস্তবে একটি গ্রাম হারিয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় মেম্বার রবিন বিশ্বাস বলেন, ‘তদের সব অভিযোগ সত্য নয়। রাস্তা তৈরি করার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রাস্তা করা সম্ভব হয়নি। অন্য জমির মালিকরা বাধা দেন। এরপরও আমাদের সাধ্যমতো উন্নয়ন করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন ভাতার কার্ডসহ সরকারি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছি।’
‘একটি বাড়ি নিয়ে একটি গ্রাম’ এর সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় রুপাপাত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজিজার রহমান মোল্লা জানান, ‘গ্রামটি ছোট হলেও উন্নয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অন্য জমির মালিকরা জমি থেকে মাটি কাটতে দেয় না, বাধা দেয়। তাই রাস্তা-ঘাট করা যায় না।’
এ প্রসঙ্গে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ্র বলেন, ‘এ গ্রামের কথা আমি জানি না। আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ জানাননি। এখন জানলাম। আমি অবশ্যই গ্রামটির খোঁজখবর নিব। আমি নিজে গ্রামটি দেখতে যাব।’
উল্লেখ্য, তথ্য সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ‘শ্রীমুখ’ গ্রামটিই এশিয়ার সবচেয়ে ছোট গ্রাম। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউপিতে অবস্থিত এই শ্রীমুখ গ্রামটি। সরকারি গেজেটভুক্ত এই গ্রামটিতে স্বাধীনতার আগে থেকেই বসবাস করে আসছে একটি মাত্র পরিবার। যার লোকসংখ্যা চারজন। সে হিসেব অনুযায়ী ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামটি ছোট গ্রাম হিসেবে এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় ছোট গ্রাম।
নদী বন্দর / বিএফ