ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। নগরীর ব্যস্ততম মগবাজার ওয়ারলেস গেট এলাকা। যানজটের কারণে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ি। হঠাৎ বিকট শব্দ। এরপর একসঙ্গে কয়েকটি ভবন থেকে রাস্তায় গ্লাস ভেঙে পড়ার শব্দ। চারদিকে কান্না আর আহাজারি। বাঁচার আকুতিতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি।
বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে, শান্তিনগর ও মগবাজার মোড় এলাকা থেকেও শুনতে পান অনেকে। এ সময় রাস্তায় জোরে কম্পনও হয়। যে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটি সামনে থেকে তিনতলা মনে হলেও পেছনে দিকে আরেক তলা দেখা যায়। ভবনটির সামনেল দিকে মূল রাস্তা থাকলেও পেছনে গলির মতো রাস্তা রয়েছে। সামনের দিকে নিচতলা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর পেছনের দিকে দোতলাসহ নিচতলা প্রায় উড়ে গেছে।
সড়কের উপর লাব্বাইক পরিবহন ও আল মক্কা পরিবহনের দুটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুটি বাসের সবগুলো কাঁচ ভাঙা ছিল, আরও ভেতরে ছিল রক্তের দাগ।
দূর থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়
ঘটনার বর্ণনায় দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর সোলায়মান কবির বলেন, ‘রোববার যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে তার অল্প কিছু দূরে যানজটের মধ্যে একটি বাসে ছিলাম। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের কথা শুনে বাস থেকে নেমে দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসি। এসে দেখি ভবনের নিচে দুটি বাস, আর বিপরীত পাশে আরেকটা বাস। মানুষ এখানে-সেখানে রাস্তায় পড়ে ছিল। আমরা ধরাধরি করে মেডিকেলে নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় লোকাল বাসে নরমালি লোক দ্বিগুণ ওঠে। যদি ৫০ করে ধরেন, তাহলে তিন বাসে দেড়শ জন হবে। যাত্রীদের অনেকেই আহত হয়েছেন। আবার হকার ছিল, তারাও রাস্তায় পড়ে ছিলেন।’
পথচারী জামাল উদ্দিন জানান, তিনি মতিঝিলের একটি হোটেলে চাকরি করেন। কর্মস্থল থেকে মগবাজারে বাসায় হেঁটে ফেরার সময় ওয়ারলেস মোড়ে পৌঁছালে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। কাঁচের টুকরা এসে তার শরীরেও বিদ্ধ হয়।
বিস্ফোরণে পুড়ে গেছে তিনটি বাস
নাসির উদ্দিন নামের একজন জানান, ‘বিস্ফোরিত ভবনের পাশে একটি রেস্টুরেন্টে বসে বার্গার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে বার্গার খাওয়া বাদ রেখে বাইরে চলে আসি। বাইরে এসে দেখি লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। বাসে থাকা যাত্রীরা রক্তাক্ত অবস্থায় নেমে আসছে। এ এক বীভৎস চিত্র। তখনকার চিত্র মনে হলে শরীরে কাঁপুনি চলে আসছে। নিজের চোখে দেখা না গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না।’
তিনি বলেন, ‘রেস্টুরেন্টে বসে বার্গার না খেলে আমিও বিস্ফোরণের সময় রাস্তায় থাকতাম। তাহলে হয়তো আমিও মারা যাওয়াদের একজন হতাম।’
আশফাক সাঈদ নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায় মালিবাগ বাজারে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ। তখন দেখি রাস্তার সামনের দিকে কেঁপে উঠল। এরপর ভয়ে প্রায় দেড় দুই কিলোমিটার দৌড়েছি।’
ওয়ারলেস এলাকার বেঙ্গল মিট মাংসের দোকানের কর্মচারী ইমরান হোসেন সুমন ঘটনার সময় দোকানের ভেতরে ছিলেন। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।
আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বাসযাত্রী
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪ ভবন
রাজধানীর মগবাজার ওয়ারলেস গেট মোড়ে অবস্থিত আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ভবনের সামনে ঘটা বিস্ফোরণে আশপাশের আরও ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, বিকট শব্দের এ বিস্ফোরণে ১২টি বাণিজ্যিক ভবন ও দুটি আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি ভবনে ছিল অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘অপরাজেয় বাংলা’র কার্যালয়। এছাড়া সড়কে চলতে থাকা তিনটি যাত্রীবাহী বাসও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যে ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো হলো- আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ভবন, রাশমনো স্পেশাইলাজড হাসপাতাল, নজরুল শিক্ষালয়, আড়ং শো-রুমের ভবন, বিশাল সেন্টার, ডম-ইনো’র বাণিজ্যিক ভবন, বেস্ট বাই শো-রুমের ভবন, বেঙ্গল ট্রেডস সেন্টার ভবন, ক্যালকাটা ড্রাই ক্লিনার্সের ভবন, মগবাজার প্লাজা, হামদর্দ চিকিৎসা ও বিক্রয় কেন্দ্র এবং ভিশন অ্যাম্পোরিয়ামের শো-রুম থাকা ভবন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর প্রতিটিই বহুতল। প্রতিটি ভবনে একাধিক দোকানসহ বাণিজ্যিক অফিসের কার্যালয় রয়েছে। বিস্ফোরণে এসব দোকান ও অধিকাংশ অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি আবাসিক ভবনের নাম জানা যায়নি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম
নাশকতা নয়, গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ বিস্ফোরণের ঘটনাটি কোনো নাশকতা নয়। এখানে বোমা বিস্ফোরিত হলে স্প্লিন্টারের আঘাতে বাসসহ আশপাশের লোকজন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় গ্যাসের বিস্ফোরণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বিস্ফোরিত ভবনের নিচতলার শর্মা হাউসে গ্যাস জমে ছিল। এ কারণে বিস্ফোরণের সূত্রপাত ঘটে থাকতে পারে। গ্যাস বিস্ফোরণের কারণে আশপাশের সাতটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তিনটি বাস পুড়ে গেছে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তারা চাইলে পুলিশ কমিটিতে থাকবে।
শর্মা হাউজের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের ভূমিকা কী—এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসলে এখানে দায় তো আমাদের না। গ্যাসের সংযোগটা বৈধভাবে নেয়া হয়েছে কি-না, গ্যাসের লাইনটা সায়েন্টিফিক্যালি লিক-প্রুফ ছিল কি-না, সেটার এক্সপার্ট তো আমি না। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে। তারা এটা দেখভাল করবে। এরপর ব্যবস্থা গ্রহণের সময় যদি বাধা দেয়া হয়, আমরা দেখব।’
ব্লাস্ট-সাউন্ড ওয়েভে পাশের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন, ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে সৃষ্ট সাউন্ড ও ব্লাস্ট ওয়েভে আশপাশের সাত থেকে দশটি ভবন ও তিনটি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, রোববার সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটে আমরা খবর পাই। আমাদের টিম এখানে আসে। এটি একটি তিনতলা ভবন। এর নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান, দ্বিতীয় তলায় সিঙ্গারের একটি গোডাউন ছিল। আমরা কোনো বড় এভিডেন্স (প্রমাণ) পাইনি। ধারণা করছি, গ্যাস বা এ জাতীয় কোনো কিছুর মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমরা পরীক্ষা করছি।
বিস্ফোরণে আরও ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গ্যাস জাতীয় কিছু থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। এ ঘটনায় আহত ৩৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন ১৭ জন। মোট আহত হয় ৬০ জনেরও বেশি মানুষ। এই ঘটনায় চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন। তখন বিস্তারিত জানা যাবে।
ভবনের নিরাপত্তা মালিককেই নিশ্চিত করতে হবে
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমার ক্লিয়ার ম্যাসেজ, যারা ব্যবসা করছেন, ভবন করছেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আর তা না হলে নিজের জীবনই ঝুঁকিপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘যারা ব্যবসা করছেন নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। ইলেকট্রিক্যাল সেফটি, বিল্ডিং সেফটি, গ্যাসের সেফটির দিকে আমাদের সজাগ ও সচেতন হতে হবে। যারা ২০তলা ভবন বানাবেন, তাদের সেই ভবনের সেফটির দায়িত্ব মালিককেই নিতে হবে।’
বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ৭
বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে সাতজনে দাঁড়িয়েছে। আহত দুজন মারা গেছেন মগবাজারের কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তারা হলেন- সুবহানা নামের নয় মাসের এক শিশু এবং অজ্ঞাতনামা (৪০) এক ব্যক্তি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান জান্নাত (২২) নামের এক নারী। ঘটনাস্থলেই তার শিশুসন্তান তায়েবার (১০ মাস) মৃত্যু হয়।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেয়ার পর দুজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সেখানে রোববার রাত সাড়ে ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্বপন (৩৫) নামের একজন।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর প্রতিটিই বহুতল
দগ্ধ তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক
মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় মোট ১৭ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন মৃত এবং তিনজন ছিলেন দগ্ধ। এর মধ্যে দুজনকে আইসিইউতে, একজনকে এসডিইউতে রাখা হয়েছে। দগ্ধ তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ৯৯ শতাংশ বার্ন। আহতদের অনেকের হাত-পা ভেঙে গেছে।
ঢামেকের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীনরা হলেন- রনি (২৭), জিয়াম (২৫), মাহবুব (৩০), অজ্ঞাত (২৫), লাভলু (৬০), সাজিদ (১৮), মিজান (৪২), ইকবাল (৫০), অজ্ঞাত (২৮), ইলিয়াস (২৬), রফিকুল (৩৫), সোহেল (২৬), জহির খান (২৬), সাজ্জাদ (৩৫), আবু খায়ের (৩৫), সুভাষ (৫৮), কামাল (৪২), অজ্ঞাত (৩২), আসাদ (২৭), মোক্তার (৩৫), রতন (৩০), অজ্ঞাত (৫৫), অজ্ঞাত (৫০), অজ্ঞাত (২৫), শাহজাহান (৪৫), নয়ন (২২), মুসা (৫০), ফজল (২৫), মিজান (২৫), রাকিবুল (৩০), হৃদয় (৩০), অজ্ঞাত (৩০), ইকবাল (৩০), মামুন (৪০), মাসুদ (৫০), শাহিন (৬০), কামাল (৪২), আইয়ুব (২৫), তপন (৩৫), অজ্ঞাত (৫০), কালু (৩৫), শাহ আলম (৫০) ও নাহিদ (২৬)।
নদী বন্দর / পিকে