বৈশাখ মাসে সাধারণত থাকে ঝড়-বাদল। কিন্তু রাজশাহী অঞ্চলে এবার বৃষ্টির দেখা নেই। আকাশে মেঘেরও দেখা নেই। বৈশাখের খরতাপে পুড়ছে রাজশাহী। বৃষ্টি না হওয়ায় বাড়ছে কৃষকের বেরো ধান চাষের সেচ খরচ। খরতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর গাছের আম আর লিচুর গুটি।
লিচুর গুটি বাঁচাতে পবা উপজেলার হরিপুর এলাকায় গাছের গোঁড়ায় বালতি বালতি পানি ঢালছিলেন মকসেদ আলী। তিনি বললেন, ‘এইবার লম্বা সময় বৃষ্টি নাই। এ রকম হলে চলে কী করে! সূর্যের তাপে মনে হচ্ছে গাছের পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে, লিচু টিকবে কী করে? তাই গাছের গোঁড়ায় পানি ঢালছি। যদি উপকার হয়!’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাপাল গ্রামের আমচাষি সাইফুল ইসলাম জানান, খরায় তাঁর আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। বৃষ্টি হলে আমগুলো রক্ষা পেত। সাইফুল বলেন, সকাল-বিকাল সাধ্যমতো গাছের গোঁড়ায় পানি দিচ্ছি। কিন্তু আবহাওয়া এত গরম যে লাভ তেমন একটা হচ্ছে না। আমের জন্য এই মুহূর্তে একটা ভাল বৃষ্টি দরকার বলেও জানান এই চাষি।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, রাজশাহী মহানগরীর পূর্ব দিকে পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার কিছু অংশে গত ১১ এপ্রিল ৭ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ৯ এপ্রিল সেদিকে দুই মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী শহরেরই পশ্চিম প্রান্ত থেকে গোদাগাড়ী, তানোর এবং মোহনপুর, পবা, দুর্গাপুর এবং বাগমারায় বৃষ্টির খবর পাওয়া যায়নি।
ফলে রাজশাহীতে তাপদাহ কমছে না। রাজশাহীজুড়ে এখন কখনও চলছে মৃদু এবং কখনও মাঝারি তাপদাহ। দিনের তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর থাকলে তাকে মাঝারি তাপদাহ হিসেবে ধরা হয়। ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে বলে মৃদু তাপদাহ। আর ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র তাপদাহ হিসেবে ধরা হয়।
চলতি শুষ্ক মৌসুমে গত ১৪ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পাওয়া গেছে ২৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন ১৩ এপ্রিল সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। শনিবার ভোর ছয়টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ২২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন শুক্রবার সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ৭ এবং সর্বনিম্ন ২৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। রুক্ষ আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি খারাপ পড়ছে রাজশাহীর কৃষিতে।
রুক্ষ আবহাওয়ায় হঠাৎ এক বাতাসে গত ৪ এপ্রিল জেলার ২৮ হেক্টর জমির ধান হিটশকে নষ্ট হয়েছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কেজেএম আবদুল আউয়াল বলেন, তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় এবং বাতাসে আর্দ্রতা না থাকায় বোরো ধানের শীষ মরে যাচ্ছে। একদিন শুধু লু হাওয়ায় পুড়েছে ২৮ হেক্টর জমির ধানের শীষ। তিনি বলেন, বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকলে আমরা যে তাপমাত্রা রেকর্ড করি না কেন, এর চেয়ে অনেক বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হবে। তখন মনে হয় লু-হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এখন বাতাসে আর্দ্রতা কম, তাপমাত্রা বেশি।
তানোরের মুণ্ডমালার কৃষক জাহিদুল ইসলাম (৪০) বলেন, তাঁদের এলাকায় সেচ সংকট। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলক‚প যে পরিমাণ বোরো ধানের জমিতে সেচের চাহিদা পূরণ করতে পারে, তার চেয়েও অনেক বেশি চাষ হয়। তাই মাঠে বোরো ধান থাকা পর্যন্ত তাঁরা বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু এবার মাঠে বোরো ধান লাগানোর পর একবারও বৃষ্টি হয়নি। ফলে জমি সেচ সংকটে পড়ছে। আবার গভীর নলক‚প থেকে সেচের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বাড়ছে আবাদের খরচ।
রাজশাহীর এই তাপমাত্রা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। সর্বাত্মক লকডাউনের ভেতরেও যারা নানা কাজের সন্ধানে রাস্তায় বের হচ্ছেন তাঁরা হাঁসফাঁস করছেন গরমে। রবিবার দুপুরে রাজশাহীনগর ভবনের সামনে রিকশা নিয়ে বসেছিলেন জুলমত আলী। তিনি বলেন, এত বেশি সূর্যের তাপ যে মনে হচ্ছে রাস্তার পিচ থেকে উত্তাপ উঠছে। রাস্তায় চলাচল করা কঠিন। জুলমত বলেন, লকডাউনের জন্য মোড়ে মোড়ে পুলিশ রিকশা আটকাচ্ছে। তখন রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছেন, ততক্ষণ গায়ে বাতাস লাগছে না। রোদে দাঁড়িয়ে থাকতেই লকডাউনে বের হওয়ার ‘শিক্ষা’ হয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে মৃদু তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা সামান্য কমছে। তবে রাজশাহীতে তাপমাত্রা খুব একটা কমছে না। বৃষ্টিপাত না হলে আপাতত তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু কখন বৃষ্টি হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
নদী বন্দর / জিকে