বাংলাদেশের মাটি যে সোনাফলা সেটা ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন আব্দুল মোতালেব। তাই সাহস করেছিলেন মরুর দেশের খেজুর বীজ এনে দেশে ফলানোর। ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামের এই মানুষটি শুধু সুস্বাদু ও মিষ্টি খেজুরই ফলাননি, মাত্র সাতটি গাছ থেকে হাজার হাজার চারা তৈরি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিদেশের মোহ ছেড়ে দেশে এসে হয়েছেন লাখ টাকার মালিক।
বলা যায় অপরিসীম ধৈর্য, নিষ্ঠা আর সাহসের গুণে বীজ থেকে ফলবতী গাছ তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। সরেজমিনে তার বাগানে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে অনেক গাছের ভিড়ে উঁচু-লম্বা একটি গাছ। তার জোর দাবি, এটিই বাংলাদেশের প্রথম সৌদি খেজুরের গাছ, যেটিতে ফল ধরেছে। কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজকে উৎসর্গ করা গাছটি আজোয়া খেজুরের।
কেন শাইখ সিরাজকে উৎসর্গ করা জানতে চাইলে ‘খেজুর মোতালেব’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া এই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রথম যখন এই গাছটিতে ১৪টি খেজুর আসে, তখন শাইখ সিরাজ এসে সেগুলো গাছ থেকে নামিয়েছিলেন। এছাড়া উনি বিভিন্নভাবে আমাকে সহায়তা করেছেন, এখনও করেন। তাই ওনার জন্য এ গাছটি রেখে দিয়েছি। এটা সবাই জানে।’
আব্দুল মোতালেব জানান, বাগান শুরু করেছেন ২০০১ সালে। তবে তার আগে ১৯৯৮ সালে যান সৌদি আরব। সেখানে কাজ করতে করতে একপর্যায়ে কাজ পান খেজুর বাগানে। দুই বছরে বেতন বেড়ে হয় ছয়শ রিয়াল। বাড়ি থেকে দেশে ফেরার তাগাদা পেতেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফিরে আসবেন, আর কখনো সৌদি যাবেন না। তিনি ছুটিতে এলে আর ফিরবেন না, এটা আঁচ করতে পেরে সৌদির মালিকপক্ষ তার ছয় মাসের বেতন আটকে দেয়। সেই বেতন না নিয়েই মোতালেব দেশে চলে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন ৩৫ কেজি বীজ খেজুর।
মোতালেব বলেন, ‘বাগানে কাজ করতে করতে একদিন খেজুর নামালাম গাছ থেকে। খেয়ে দেখলাম পৃথিবীতে যত ফল আছে এর ওপর কোনো ফল নেই। এত স্বাদ। সেটা ছিল আজোয়া আর সুক্কারি জাতের খেজুর। সেদিন থেকেই আমার টার্গেট ছিল দেশে আমার এই খেজুর নিয়ে যেতেই হবে।’
কোনো কিছুতে সহজে হাল না ছাড়া মোতালেব বলেন, ‘লোকে বিদেশে গেলে স্যুটকেসভর্তি জিনিস নিয়ে আসে, আর আমি আনছিলাম খেজুর। দেশের মানুষ হাসাহাসি করতো, পাগল বলতো। আমার দেওয়া বীজ থেকে ২৭৫টি চারা বের হয়। চারাগুলো সাইজ করে লাগাইনি। তিন বছর তো বেশি সময় না, মুকুল এলে চারা লাগাবো। শুরু করি ২০০১ সালে। ১৭ মাস পর একদিন আমার বউ এসে বললো— তোমার গাছে মুকুল আইছে। আমি তো বিশ্বাসই করিনি। পরে বাজি ধরে গিয়ে দেখি সত্যি মুকুল বের হয়েছে, কিন্তু পুরুষ। তখন একটা সাহস এলো পুরুষ মুকুল যখন আসছে তখন মেয়েও হবে। সেটা চৈত্র মাসের ১৭ তারিখ ছিল। বৈশাখে একটা এলো সেটাও পুরুষ। পরের বছর পাঁচটা, তারপরের বছর সাতটা, তার পরেরবার নয়টা গাছে মুকুল এলো, সবগুলো পুরুষ। তবুও হতাশ হইনি। তবে টেনশন বাড়ছিল।’
‘হাল ছাড়ছিলাম না। পরের বছর ১১টা গাছের মধ্যে একটা গাছে মেয়ে মুকুল এলো। তুলে আলাদা করে লাগালাম। এই গাছটাই শাইখ সিরাজের নামে রাখলাম। আজোয়া গাছ। এটাই বাংলাদেশে প্রথম সৌদি খেজুর গাছ। প্রতি বছর উনি আসেন একবার। ওনার কাছে অনেক ঋণ আছে বলেই এটা ওনার নামে রেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘বাগান এখন ১০ বিঘার। পাঁচ বিঘার বীজ বাগান। আমি কাটিং জানি। নারী গাছে গজানো চারাগুলো নারীই হয়। সেগুলো পুরুষ গাছে কাটিং করে বসাতে হয়। সারাদেশে এটা আমার মতো কেউ পারে না। আমার সব গাছ কাটিং করে মেয়ে বানাইছি। প্রথম গাছটি ছিল একটি আজোয়া খেজুর। এটা থেকে এখন আমি বছরে একশ কেজির মতো খেজুর পাই। আর এই গাছ থেকে এ পর্যন্ত কাটিং করে শতাধিক চারা তৈরি করেছি। সামনে বড় যে গাছটি দেখছেন তা এই গাছেরই কাটিং।’
এই একশ চারার দাম হিসাব করে দেখা যায়, একটি গাছ থেকে তিনি শুধু চারা বানিয়েছেন ৫০ লাখ টাকার।
নিজেকে ‘খেজুর মোতালেব’ পরিচয় দিতে ভালোবাসা এই ব্যক্তি জানান, সাধারণত প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মুকুল আসে। ফল আসে জুন, জুলাই, আগস্টে। কাঁচা খেজুর বেশি বিক্রি করেন মোতালেব। তার বাগানের খেজুরের সর্বনিম্ন দাম এক হাজার টাকা কেজি। সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। তার বাগানে আছে আজোয়া, সুক্কারি, মরিয়ম, আম্বার, বকরি ও বাঁশি জাতের খেজুর। আজোয়া সবচেয়ে বেশি চলে। আম্বারের দাম সবচেয়ে বেশি। আজোয়া বিক্রি হয় কেজিপ্রতি আড়াই হাজার টাকা।
মোতালেবের অভিজ্ঞতায় এমনও হয়েছে, সৌদির চেয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত খেজুরের নাকি স্বাদ বেশি। আর সুক্কারি খেজুর সাইজে ছোট কিন্তু ফলন বেশি। লম্বা হয় আম্বার খেজুর। আসল সৌদির যে পাঁচটি জাত আছে তার সবগুলো আছে তার। তবে সুক্কারি আর আজোয়া গাছই বেশি।
নদী বন্দর / এমকে