প্রতিবেশী লাইলি আক্তারের (৩০) সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কুমিল্লার দেবিদ্বারের ট্রাক্টরচালক আমির হোসেন (২৫)। বয়সে পাঁচ বছরের বড় লাইলির সঙ্গে আমিরের সম্পর্ক বছরখানেক। হঠাৎ একদিন আমিরকে লাইলির সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থিত দেখে ফেলেন পাঁচ বছরের শিশু ফাহিমা।
ফাহিমা বলে, ‘আমি এ কথা মাকে জানিয়ে দেবো।’ ফাহিমার এ কথায় কাল হয়েছে। ঘটনা চাপা দিতে লাইলির প্ররোচনায় নিজের মেয়ে ফাহিমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে বাবা আমির হোসেন।
আমির ও লাইলি পরিকল্পনা করে, ফাহিমাকে মেরে ফেললে পথ পরিষ্কার। অনৈতিক সম্পর্ক কেউ জানবে না। পরে স্ত্রীকে খুন করে বা ডিভোর্স দিয়ে লাইলিকে নিয়ে সংসার পাতবে আমির।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন মেয়েকে চকলেট কিনে দেওয়া ও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নির্জন স্থানে নিয়ে হাত-পা বেঁধে ছুরিকাঘাত করে শিশুটির চাচা রেজাউল। পরে শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে বাবা আমির হোসেন নিজেই।
শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পর বাবা নিজেই গ্রামে মাইকিং করে এবং বিভিন্ন স্থানে শ্বশুর-শাশুড়িসহ খোঁজাখুঁজি করেন। পরে থানায় জিডি ও মামলা দায়ের করেন।
তবে শিশু ফাহিমার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধারের পর ব্যবহৃত গরুর খাবার ফিডের বস্তার সূত্র ধরে বাবা আমির হোসেনসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
বুধবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাবার পরিকল্পনায় নিজের মেয়ে ফাহিমা হত্যার নির্মম ঘটনার বর্ণনা দেন র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এ ঘটনায় কুমিল্লার দেবিদ্ধার ও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা হতে গ্রেফতাররা হলেন- নিহতের বাবা আমির হোসেন (২৫), রবিউল আউয়াল (১৯), রেজাউল ইসলাম ইমন (২২), মোসা. লাইলি আক্তার (৩০) ও সোহেল রানা (২৭)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ৭ নভেম্বর বিকেলে কুমিল্লার দেবিদ্বারে ৫ বছরের শিশু ফাহিমা আক্তার নিখোঁজ হয়। শিশু ফাহিমার বাবা আমির হোসেন দেবিদ্বার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। নিখোঁজের পর ভিকটিমের পিতা আমির হোসেন ৭ ও ৮ নভেম্বর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে। এমনকি গত ৮ নভেম্বর ঝাড়-ফুঁক দিয়ে মেয়েকে খোঁজার জন্য একজন কবিরাজকেও খবর দেয়।
‘পরে ১৪ নভেম্বর পুলিশ দেবিদ্বারের কাচিসাইর গ্রামের একটি ডোবা থেকে ভিকটিমের বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিচয় নিশ্চিত করে নিহতের পরিবার। ওই ঘটনায় ঘাতক বাবা আমির হোসেন বাদী হয়ে দেবিদ্বার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নির্মম এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় র্যাব-১১ ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন এবং জড়িত বাবাসহ ৫ আসামিকে গ্রেফতারে সমর্থ হয়।’
র্যাব কর্মকর্তা জানান, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৬ নভেম্বর রাতে রেজাউল ইসলাম ইমনের ফার্নিচার দোকানে ভিকটিমের বাবা আমির হোসেন টাকার বিনিময়ে রবিউল আউয়াল, রেজাউল ইসলাম ইমন ও সোহেল রানাকে সঙ্গে নিয়ে ফাহিমাকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যা করার জন্য ধারালো ছুরি ও হত্যার পর মরদেহ লুকানোর জন্য দুটি প্লাস্টিকের বস্তা সংগ্রহ করে। গত ৭ নভেম্বর বিকেলে কৌশলে চকলেট কিনে দেওয়া ও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে চাঁপানগর রাস্তার মোড়ে সোহেল রানার সিএনজিতে করে দেবিদ্বার পুরান বাজারের দক্ষিণে নদীর নির্জন স্থানে শিশু ফাহিমাকে নিয়ে যায়। সেখানে ছুরিকাঘাত ও শ্বাসরোধে ফাহিমাকে হত্যা করা হয়।’
‘হত্যার ফাহিমার মরদেহ প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে সিএনজিতে করে ইমনের গরুর গোয়ালে ড্রামে লুকিয়ে রাখে। ৯ নভেম্বর রাতে সোহেল রানার সিএনজিতে করে আমির হোসেন, রবিউল, ইমন বস্তাবন্দি ফাহিমার মরদেহ কাচিসাইরে কালভার্টের নিচে ডোবায় ফেলে দেয়।’
হত্যাকারীদের শনাক্ত করা হলো কীভাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘শিশু ফাহিমাকে হত্যার পর গরুর খাবারের ২৫ কেজির একটি বস্তায় মরদেহ ভরে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল মরদেহ। সেটিই প্রথম আমলে নেয় র্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা। বস্তার খোঁজে পাশ্ববর্তী দুটি গরুর খামারে অভিযানে যায়। সেখানে ইমনের বাবার খামারে গিয়ে ২৫ কেজি গরুর খাবারের বস্তা দেখে র্যাব সদস্যরা। এরপর ইমনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে হত্যার মূল রহস্য। এরপর একে একে গ্রেফতার করা হয় বাবা আমির হোসেনসহ অন্য আসামিরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেফতারের পর আমরা আমির হোসেনকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তবে তার নিজ সন্তানকে হত্যা নিয়ে অনুশোচনা নেই। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল আমির। কারণ লাইলি আক্তারকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আমির।’
নদী বন্দর / সিএফ