বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশে ৮০ জনেরও বেশি লোকের শরীরে ভাইরাসবাহিত অসুখ মাংকিপক্স সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মাংকিপক্সের জীবাণুর প্রবেশ ঠেকাতে সব বন্দরে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরকে এ ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অসুস্থ কোনো ব্যক্তি কিংবা সন্দেহভাজন কেউ নজরে এলে তাকে শনাক্ত করে আইসোশেলনে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে দ্রুত তাকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তবে এটা নিয়ে আপাতত আতঙ্কের কিছু নেই।
মাংকিপক্সের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন গতকাল শনিবার বলেন, বাংলাদেশে মাংকিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে এটি যেভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সে ক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।
অন্তত ১২ দেশে মাংকিপক্স : এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের ৯টি দেশসহ অন্তত ১২ দেশে মাংকিপক্সের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আরো সংক্রমণ শনাক্ত হতে পারে জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বলেছে, তারা আক্রান্তদের খুঁজে বের করে সহায়তা দিতে আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে।
মাংকিপক্স একটি বিরল ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ, যা সাধারণত মৃদু থাকে। মাংকিপক্স ভাইরাস গুটি বসন্তের মতো একই ভাইরাস পরিবারের সদস্য। তবে এটি অনেক কম গুরুতর।
বেশির ভাগ আক্রান্তই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠে। এ ভাইরাস মানুষের মধ্যে সহজে ছড়ায় না। মাংকিপক্সের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট টিকা নেই। তবে স্মলপক্সের টিকা এ ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে সক্ষম। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও সাহায্য করতে পারে।
মাংকিপক্স মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। এ কারণে গত শুক্রবার দেওয়া বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবগুলো ‘অস্বাভাবিক, কারণ এগুলো অস্থানীয় দেশগুলোতে দেখা দিচ্ছে। ’ মাংকিপক্সের জন্য কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর দায় আরোপের ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থার ইউরোপের আঞ্চলিক পরিচালক হ্যানস ক্লাগ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রবেশ করছি…বড় জমায়েত, উৎসব ও পার্টি হবে এ সময়, আমি উদ্বিগ্ন যে সংক্রমণ বাড়তে পারে। ’
নিশ্চিত ৮০টি সংক্রমণ ছাড়াও আরো ৫০টি সন্দেহজনক সংক্রমণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএইচও। এখন পর্যন্ত ইউরোপের সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও সুইডেনে সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করেছে।
যুক্তরাজ্যে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ মে। ওই রোগী এর আগ দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার নাইজেরিয়া ঘুরে এসেছিলেন। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থার ধারণা, সেখান থেকেই ভাইরাসটি তাঁর দেহে এসেছে। অন্তত যুক্তরাজ্য ও স্পেন প্রয়োজনে লাগতে পারে ভেবে স্মলপক্সের টিকা সংগ্রহ করেছে।
বিবিসি অনলাইনে বলা হয়েছে, মাংকিপক্সের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথা ব্যথা, ফুলে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা ও সাধারণ ক্লান্তি। জ্বর সারা শুরু হলে গোটা উঠতে পারে। সাধারণত তা মুখমণ্ডল থেকে শুরু হয়। এরপর শরীরের অন্যান্য অংশে, সাধারণত হাতের তালু এবং পায়ের তলায় ছড়িয়ে পড়ে। গোটায় খুব চুলকানি হতে পারে। সংক্রমণটি সাধারণত নিজে থেকেই চলে যায়। এটি ১৪ থেকে ২১ দিন স্থায়ী হয়। কেউ সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাংকিপক্সে আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাসটি ত্বকের ক্ষত, শ্বাসতন্ত্র বা চোখ, নাক বা মুখ দিয়েও শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
এ ভাইরাসের প্রভাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হালকা। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজেই সেরে যায়। তবে কখনো কখনো গুরুতর হতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকায় এতে মানুষের মৃত্যু হতে দেখা গেছে। এদিকে মাংকিপক্স ঠেকাতে ভারতের বিমাবন্দরগুলোতে আগাম সতর্কতা জাজি করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ যা বললেন
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘মাংকিপক্স আফ্রিকায় যারা বন্য প্রাণীর সংস্পর্শে থাকে, তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। সেদিক থেকে এটি অনেকটা অ্যানথ্রাক্সের মতো। আমাদের দেশে প্রতিবছর একটি সময়ে চিকেন পক্স ছড়ায়। দেশে যাদের চিকেন পক্স হচ্ছে, এখন পরীক্ষা করে দেখতে হবে তাদের চিকেন পক্স না মাংকিপক্স হয়েছে। কারণ দুটির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে। মাংকিপক্স লক্ষণবিহীন নয়। লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাণীর মধ্যেও এটি পরীক্ষা করতে হবে। ’
ডা. মোস্তাক হোসেন জানান, তাঁর জানা মতে মাংকিপক্সের টিকা প্রাণীর মধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে এখনো তা ব্যবহার করা হয়নি। জরুরি ক্ষেত্রে স্মলপক্সের টিকা দিয়ে কাজ চালানো যেতে পারে। তবে স্মলপক্সের টিকাও সবাইকে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী মাংকিপক্সের রোগী নিয়ে কাজ করবেন তাঁদের এবং কোনো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে সেই পরিবারকে দেওয়া যেতে পারে। মাংকিপক্স ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এর জন্য যে টিকা রয়েছে তা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে সবার জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে।
নদী বন্দর/এসএফ