অকাল বন্যা থেকে বোরো ধান রক্ষা করতে প্রতি বছর যেভাবে ‘হাওর রক্ষা’ বাঁধ দেওয়া হয়, তা মাছের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। ‘যেখানে সেখানে বাঁধ নির্মাণের ফলে হাওরের মাছ কমে যাচ্ছে,’ এই মন্তব্য করে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু বলেন, মুক্ত জলাশয় মাছের জন্য নিরাপদ এবং নির্বিঘ্নে চলাচল খুবই জরুরি। এটি বাধাগ্রস্ত হলে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাছের প্রজনন সমস্যা হচ্ছে। অনেক প্রজাতি বিলুপ্তি হয়েছে। আরো প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। অবশ্য এর জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বিল সেচ দিয়ে মৎস্য নিধন, নির্বিচারে পোনা মাছ নিধনও দায়ী। এদিকে আবার হাওর রক্ষা বাঁধ ছাড়া বড় বড় হাওর পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষা করাও কঠিন। ‘কিন্তু বাঁধ নির্মাণে মত্স্যের কথা, পরিবেশের কথাও ভাবা হয় না’, বলেন, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
এবার শুধু সুনামগঞ্জ জেলাই ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। সচেতন মহল মনে করে, ‘এখন এই দুইয়ের সমন্বয় প্রয়োজন।’ এবারের বন্যায় শুধু সিলেট জেলায় ২১ কোটি টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়। সুনামগঞ্জ জেলা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ চলছে।
সিলেট মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগের হাওরগুলো এক যুগ আগেও প্রায় ১০৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। সিলেটের হাওরগুলোর ৩২ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরো কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, মহাবিপন্ন, সংকটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি। মৎস্য কর্মকর্তারা বলেন, ফসল রক্ষায় বাঁধের কারণে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। অধিক কীটনাশক ব্যবহার, হাওরের ইজারা প্রথা, সেচ দিয়ে মাছ শিকারসহ বিভিন্ন কারণে হাওরের মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। মাছ ডিম কম দিচ্ছে। সব ডিম থেকে বাচ্চাও ফুটছে না।
মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙাশ, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা। আর সংকটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া ট্যাংরা, ফলি ও গুজিআইড় এবং বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালিবাউশ।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ বায়োলজি ও জেনেটিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায় মনে করেন, ধান ও মাছ দুটোর ব্যাপারেই মনোযোগী হওয়া উচিত। তিনি বলেন, যে জায়গায় ধান হয় সেখানে ধান চাষ করতে হবে। আর যে জায়গায় ধান হয় না, অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সেখানে মাছ চাষে মনোযোগী হতে হবে। বাঁধের মাটি বৃষ্টির সঙ্গে ধুয়ে হাওর ও বিলে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিলগুলো থাকবে না। ফলে ধান ও মাছ দুটোরই ক্ষতি হবে।
নদী বন্দর/এবি