দেশে ফেরার আকুতি বিশ্বকে জানাতে নিরব সমাবেশ করেছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। ‘গো হোম ক্যাম্পেইন’-শিরোনামে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে স্ব-উদ্যোগে এ সমাবেশ করেছে তারা। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে অনলাইন-অফলাইনে রোহিঙ্গারা ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শৃংখলা বাহিনীর সদস্য এবং সংশ্লিষ্টরাও তাদের এ দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
রবিবার (১৯ জুন) সকালে উখিয়া-টেকনাফের ১০টি ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থানে মিয়ানমারে বাপদাদার ভিটায় ফেরার দাবি নিয়ে পৃথক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
উখিয়ার ৯, ১৪, ১৩, ১৭, ২ ওয়েস্ট, ১ ওয়েস্ট, ৪ ও ১৮নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থানে সকাল ৮টা থেকে সমাবেশে আসা শুরু করে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোর পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের সববয়সী রোহিঙ্গারা এখানে অংশ নিয়েছেন।
একই দাবিতে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তের গুলি নিহত হন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বপ্ন দেখানো নেতা মুহিবুল্লাহ।
তবে, এবারের সমাবেশের একক কোন আয়োজক কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ সামনে না এলেও প্রচারপত্রে আয়োজক হিসেবে ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ লেখা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলেই ডাকা, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে আরাকানের গ্রামে গ্রামে প্রত্যাবাসন, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রত্যেক চুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশ, এনজিও, সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা, বার্মার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, সম্পত্তি ফেরত, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারসহ নানা দাবী উত্থাপন করা হচ্ছে সমাবেশে।
উখিয়ার ১৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি হোসাইন আহমদ বলেন, ‘সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসন চাই। আমাদের আশা সমাবেশে উত্থাপিত রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব পাবে।’
নয়াপাড়া শিবিরের রোহিঙ্গা আমির হোসেন বলেন, ‘সম্মান ও মর্যাদার সাথে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরতে চাই। বিশ্ববাসীর কাছে এটাই আমাদের মূল দাবী। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, আমরা কৃতজ্ঞ।’
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে নিজ দেশে বাড়ি ফেরার আকুতি জানাচ্ছেন। শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করছে তারা।’
তাদের দাবি সম্বলিত প্লেকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন ছাড়া বড় কোনো জমায়েত কিংবা বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ক্যাম্পে আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিত ১৬ এপিবিএন অধিনায়ক (এসপি) তারিকুল ইসলাম তারিক ও ৮ এপিবিএন অধিনায়ক (এসপি) শিহাব কায়সার খান জানান, ‘সমাবেশের তথ্য আমরা আগেই পেয়েছি। ক্যাম্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে সকল প্রস্তুতি ও সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে চারপাশে।’২০১৭ সালের আগস্টে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে নতুন করে পালিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা, সরকারি হিসেবে যাদের সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখেরও বেশি। পরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়ার টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বিশাল বনভূমি হারিয়ে ফেলে। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আনাগোনায় উখিয়া-টেকনাফ পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের জনপদে। ফসলের জমি বিনষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা, ব্যয়বৃদ্ধিসহ নান কারণে দিনদিন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে রোহিঙ্গাদের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় দেখছেন রোহিঙ্গাদের নিজদেশে প্রত্যাবাসন। তাই যে কোনো উপায়ে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
২০১৮ সালের দিকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে আর্বিভাব হয় মাস্টার মুহিবুল্লাহ’র। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নিয়ে যেতে সংগঠিত করেছিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জোরালো জনমত গড়ে তুলেছিলেন। তিনিই শুরু করেছিলেন ‘গোয়িং হোম’ ক্যাম্পেইন। কিন্তু প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গাদের একটি চক্র ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি ব্লকে সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী আটক হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছে। সম্প্রতি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে আদালতে।
এদিকে, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন আর অস্ত্রের মহড়া বেড়েই চলেছে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য মাস্টার মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন গ্রুপ, মো. ইসলাম গ্রুপ ও আরসার মধ্যে দিনদিন সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। বৃহস্পতিবার রাতে অত্যাধুনিক এম-১৬ ডিজাইনের একটি অস্ত্র উদ্ধার করেছে এপিবিএন। এই ধরণের ভারী অস্ত্র এর আগে ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হয়নি। তাই বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।
তবে নিজেদের মাদক কারবারসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড জিইয়ে রাখতে নবী হোসেন গ্রুপ, আরসাসহ সকল সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রত্যাবাসন ঠেকাতে তৎপর। তাই তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে খুন ও নাশকতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে একাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝির দাবী।
নদী বন্দর/এসএফ