পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর গত এক বছরে পাল্টে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চিত্র, মানুষের জীবনযাত্রার ধরন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যে অন্যতম বাগেরহাট।
গত এক বছরে এই জেলায় বেড়েছে পর্যটক, কর্মসংস্থান। এছাড়া মোংলা বন্দর দিয়ে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে, কৃষি খাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। কৃষকের ফসল পচে যায় না আর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া কিংবা শরীয়তপুর-জাজিরা ঘাটে। অসুস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে আর অপেক্ষা করতে হয় না ফেরির জন্য। এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে স্বস্তির হাসিতে হাসছে সাধারণ মানুষ।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে বাগেরহাটের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। বেড়েছে পণ্য পরিবহনকারী যানবাহন ও যাত্রীবাহী বাস। বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দিনে দিনে বাড়ি ফিরে আসতে পারছে মানুষ। পদ্মার পাড়ে আর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না কৃষকের পণ্য নিয়ে। অসুস্থ ব্যক্তিকে আর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না ফেরির জন্য।
এ বিষয়ে বাগেরহাট বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তালুকদার আব্দুল বাকি বলেন, পরিবহন সেক্টরের বড় স্বপ্ন ছিল পদ্মা সেতু। এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে যেমনি পরিবহন সেক্টর অনেকটা এগিয়ে গেছে, তেমনি যাত্রীদেরও যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। বাগেরহাট থেকেই সরাসরি পদ্মাসেতু হয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
মোংলা বন্দর
পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকার থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মোংলার দূরত্ব কম হওয়ায় পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ব্যবহার শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে প্রথমবারের মতো গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে এই বন্দর থেকে। এক বছরে ৫টি জাহাজে করে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
পাশাপাশি কন্টেইনারবাহী জাহাজের আগমন বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে যেখানে কন্টেইনারবাহী জাহাজ এসেছিল ৪৫টি, এবার এসেছে ৫২টি। মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ৬ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মীর এরশাদ আলী।
তিনি বলেন, বর্তমানে বন্দর এলাকায় ১১টি এলপিজি কারখানা, ৫টি সিমেন্ট কারখানা ও বিভিন্ন ধরনের ১০টি শিল্প কারখানা রয়েছে। বন্দরের ২৫৮ একর জমিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেপজা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বেড়েছে কয়েকগুণ। বিদেশি জাহাজের আগমন-নির্গমন বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও দক্ষিণালে পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ এখনও পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ। সেতুর সুফল পুরোপুরি পেতে এবং নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের বিকল্প নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে ব্যবসায়ীরা উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ আমাদের এদিকে গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার আরও বৃদ্ধি করতে সরকারের কাছে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান তিনি।
মৎস্য খাত
পদ্মাসেতু চালুর মধ্য দিয়ে এক বছরে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাগেরহাটে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১০ শতাংশ। অল্প সময়ের মধ্যে এই জেলায় উৎপাদিত বাগদা, গলদা, রুই, কাতলসহ বিভিন্ন প্রকার সাদা মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। চাষিদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও লাভবান হচ্ছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে বাগেরহাট জেলার মৎস্য সেক্টর নতুন করে আশার আলো দেখছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় যেমন বেড়েছে তাজা মাছের চাহিদা, তেমনি চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়া রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাদা মাছের দাম কেজি প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরা উৎসাহিত হচ্ছেন মাছ চাষে। অন্যদিকে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়ার দামও বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। গেল বছর জেলায় ৯৯ হাজার মেট্রিক টন সাদা মাছ উৎপাদন হলেও এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন।
পর্যটন শিল্প
বিশ্ব ঐতিহ্যের জেলা বাগেরহাটের পর্যটন আগে থেকেই সমৃদ্ধ হলেও ভালো ছিল না দেশের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা দক্ষিণাঞ্চল বাগেরহাটের সঙ্গে। কাঙ্ক্ষিত দর্শনার্থী আসতেন না এখানে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ এবং সুন্দরবনে উল্লেখযোগ্য হারে দর্শনার্থী ও রাজস্ব আয় বেড়েছে কয়েকগুণ।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, গত এক বছরে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৮ জন দেশি ও ১ হাজার ৬৭৫ বিদেশি দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে। যার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬৭ হাজারে টাকা। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাগেরহাটের কাস্টোডিয়ান মোহাম্মাদ যায়েদ জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৮ জন দেশি ও ১ হাজার ৪৮২ জন বিদেশি দর্শনার্থী এসেছেন। যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৭ লাখ টাকা। গেল বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশি দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার এবং বিদেশি দর্শনার্থী ছিল ২৮৯ জন।
কৃষি খাত
গত এক বছরে কৃষিনির্ভর এই জেলায় কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ শতাংশ। এছাড়া উৎপাদিত সবজি সহজে বাজারজাত করায় কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়েছে। গত বছর যেখানে হেক্টর প্রতি সবজির উৎপাদন ছিল ২০ মেট্রিকটন, সেখানে বর্তমানে ২৫ মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার আসায় কৃষকদের সবজি সহজে বিক্রি হয়ে যায়। কোন সবজি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা নেই। এছাড়া অনেক কৃষক নিজেই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে সবজি সরবরাহ করছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতায় পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। এই অঞ্চলের মানুষের সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়েছে। মোংলা বন্দর কেন্দ্রিক নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, পর্যটন, কৃষি, মৎস্য ও বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। যার সুফল এখন দৃশ্যমান। পদ্মাসেতু ঘিরে এ অঞ্চলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নদী বন্দর/এসএস